হাওরে শতকোটি টাকার বোরোর ক্ষতি

সুনামগঞ্জে ১৭টি হাওর ও বিলের ৫ হাজার ৫১০ হেক্টর জমির বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে। হবিগঞ্জে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫০০ হেক্টর জমির ধান।

পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। হাওরে পানি বেড়ে যাওয়ায় তড়িঘড়ি করে আধা পাকা ধান ঘরে তুলছেন কৃষকেরা। গতকাল দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ডাবর এলাকায়
ছবি: আনিস মাহমুদ

উজান থেকে আসা ঢলের পানিতে সুনামগঞ্জে একের পর এক বাঁধ ভেঙে ও উপচে হাওরের বোরো ধান তলিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ রোববার রাতে দিরাই উপজেলায় বাঁধ ভেঙে হুরামন্দিরা হাওরে পানি ঢোকে। এর আগে ওই দিন বিকেলে তাহিরপুর উপজেলার গুরমার হাওরের ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। হবিগঞ্জের কয়েকটি হাওরেও ঢলের পানিতে ফসলহানি হয়েছে। পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় হাওরগুলোর আধা পাকা ধানই কেটে নিচ্ছেন কৃষকেরা।

এটা কৃষি বিভাগের মনগড়া হিসাব। হাওর থেকে গরুকে খাওয়ানোর কিছু ধান ছাড়া আর কোনো ধানই কাটা যায়নি। সব ধান কাঁচা ছিল
চণ্ডীপুর গ্রামের কৃষক আবুল খয়ের

সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি বিভাগ গতকাল সোমবার বলেছে, জেলায় এ পর্যন্ত ছোট–বড় ১৭টি হাওর ও বিলের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৫ হাজার ৫১০ হেক্টর। অন্যদিকে হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, গত দুই দিনে উজানের পানি কালনী ও মেঘনা নদী হয়ে উপজেলার হাওরগুলোতে ঢুকেছে। এতে লাখাই সদর, বামৈ ও বুল্লা ইউনিয়নের প্রায় ৫০০ হেক্টরের ধান তলিয়ে গেছে।

কৃষি বিভাগের হিসাবে, ১ হেক্টর জমিতে ধান হয় ৬ মেট্রিক টন। ১ কেজি ধানের দাম ২৭ টাকা ধরে ৬ মেট্রিক টন (৬ হাজার কেজি) ধানের দাম হয় ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা। সে অনুযায়ী সুনামগঞ্জে ৮৯ কোটি ২৬ লাখ ২০ হাজার টাকার ধানের ক্ষতি হয়েছে। হবিগঞ্জে ৫০০ হেক্টর ধরলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ কোটি ১০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ৯৭ কোটি ৩৬ লাখ ২০ হাজার টাকার বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে।

আরও পড়ুন

তবে এ হিসাব মানতে নারাজ স্থানীয় কৃষক ও হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা। তাঁরা বলছেন, গতকাল পর্যন্ত হাওরে অন্তত ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো বিভিন্ন হাওরে পানি ঢুকছে। তাই ক্ষতি আরও বাড়বে।

ইউনিয়নের সব মানুষের ধান ছিল চাপতির হাওর ও হুরামন্দিরা হাওরে। সব ধান তলিয়ে গেছে। চাপতির হাওরে কোনো ধানই কাটা যায়নি। হুরামন্দিরা হাওরে আধা পাকা কিছু ধান লোকজন কেটেছেন, সেটা অর্ধেকের বেশি হবে না
জগদল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হুমায়ুন রশিদ

৩০ মার্চ থেকে উজানের ঢল নামছে। ২ এপ্রিল প্রথম সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালি এলাকার বাঁধ ভেঙে ফসলহানি ঘটে। এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সবচেয়ে বড় হাওর দিরাই উপজেলার চাপতির হাওর। এটির বাঁধ ভেঙে ফসলহানি ঘটে ৭ এপ্রিল। তখনো হাওরের ফসল পাকেনি। এখানে ৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। কৃষি বিভাগ ক্ষতি দেখিয়েছে, ৩ হাজার ৫০০ হেক্টরের। স্থানীয় চণ্ডীপুর গ্রামের কৃষক আবুল খয়ের বলেন, ‘এটা কৃষি বিভাগের মনগড়া হিসাব। হাওর থেকে গরুকে খাওয়ানোর কিছু ধান ছাড়া আর কোনো ধানই কাটা যায়নি। সব ধান কাঁচা ছিল।’

রোববার রাতে একই উপজেলার হুরামন্দিরা হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসলহানি ঘটে। কৃষি বিভাগ বলছে, এখানে জমি আছে ১ হাজার হেক্টর, ক্ষতি হয়েছে ২০০ হেক্টরের। সেখানকার জগদল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হুমায়ুন রশিদ বলেন, ‘ইউনিয়নের সব মানুষের ধান ছিল চাপতির হাওর ও হুরামন্দিরা হাওরে। সব ধান তলিয়ে গেছে। চাপতির হাওরে কোনো ধানই কাটা যায়নি। হুরামন্দিরা হাওরে আধা পাকা কিছু ধান লোকজন কেটেছেন, সেটা অর্ধেকের বেশি হবে না।’

আরও পড়ুন

ধান যখন একেবারে কাঁচা, তখন (৪ এপ্রিল) পাহাড়ি ঢলের পানিতে সদর উপজেলার কানলার হাওরের ফসল তলিয়ে যায়। এ হাওরে ১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি আছে বলে জানাচ্ছে কৃষি বিভাগ। হাওরটিতে ক্ষতি দেখানো হয়েছে মাত্র ১০০ হেক্টরের। স্থানীয় রঙ্গারচর ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল হাই বলেন, ‘হাওরের কিছু উঁচু জমি ছাড়া পুরোটাই তলিয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ৭০০ থেকে ৮০০ হেক্টর হবে।’

কৃষি বিভাগের হিসাবে, ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্র সোনার থাল হাওরের ১ হাজার ৬৫ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে, শাল্লা উপজেলায় ২০০ হেক্টর, ছাতকে ৩০ হেক্টর, জগন্নাথপুরে ৯০ হেক্টর ও দোয়ারাবাজারে ২০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওর ছাড়াও গুরমার হাওর, কাউজানি হাওর, ফানা হাওর ও নয়াহালট হাওরে পানি ঢুকে জমির ফসল তলিয়ে গেছে। রোববার বিকেলে ভাঙে গুরমার হাওরের বাঁধ। হাওরের তীর উপচে পানি ঢোকে কাউজানি, নয়াহালট ও ফানা হাওরে। কৃষি বিভাগ বলছে, এসব হাওরে ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ হেক্টর।

তবে তাহিরপুরে এ পর্যন্ত দুই থেকে আড়াই হাজার হেক্টর জমির ধানের ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরীর। তিনি বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে হবে। এতে সরকারের পরবর্তী কার্যক্রম বা কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে সুবিধা হবে।’

কৃষি বিভাগের হিসাবে, ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্র সোনার থাল হাওরের ১ হাজার ৬৫ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে, শাল্লা উপজেলায় ২০০ হেক্টর, ছাতকে ৩০ হেক্টর, জগন্নাথপুরে ৯০ হেক্টর ও দোয়ারাবাজারে ২০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, ‘ক্ষতি কম দেখানো মানে কৃষকের আরও ক্ষতি
করা। বাঁধ নির্মাণে যারা অনিয়ম-দুর্নীতি করেছে, তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করা। কৃষি বিভাগ যেন এটা না করে।’

ক্ষতির প্রকৃত চিত্রই তুলে ধরা হয় উল্লেখ করে সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘আমাদের চিন্তায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সহায়তার বিষয়টিও থাকে। সুতরাং কম দেখানোর কথা সঠিক নয়।’

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি, হবিগঞ্জ)