‘হামি খালি চোখ দুটা চাহি, আর কিছু চাহি না’

ককটেল বিস্ফোরণে কবজি ও চোখের দৃষ্টি হারানো শিক্ষার্থী মহরমী আক্তার। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার গণকা বিদিরপুর মহল্লার বাড়িতে রোববার তোলা ছবি
প্রথম আলো

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার গণকা বিদিরপুর মহল্লায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুটি গ্রুপের মধ্যে বিবাদ চলছে কিছুদিন থেকে। এর জেরে গত ১ ফেব্রুয়ারি এলাকায় কয়েক দফা ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তাদেরই কোনো এক পক্ষের ফেলে যাওয়া ককটেল কুড়িয়ে পায় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মহরমী। তার হাতেই ককটেলটি বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণে মহরমীর ডান হাতের কবজি উড়ে যায় এবং চোখসহ মুখমণ্ডলে বিস্ফোরণের আঘাত লাগে।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর শিশুটির দৃষ্টি না আসায় তাকে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। ঢাকায় প্রথমে বাংলাদেশ চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও মিরপুরে বাংলাদেশ আই হসপিটালে চিকিৎসা করানো হয়। চিকিৎসা এখনো চলমান। চিকিৎসক জানিয়েছেন, এক চোখে দৃষ্টি ফেরার ক্ষীণ আশা রয়েছে।

শিশুটির অবস্থা জানতে গতকাল রোববার সকালে বাড়ি গিয়ে তার সঙ্গে কথা বললে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে, ‘হামি খালি (শুধু) চোখ দুটা চাহি, আর কিছু চাহি না।’  সে আরও বলে, ‘হামি দেখতে চাহি, পড়তে চাহি। কেনে হামার জীবনটা আন্ধার হয়্যা গ্যালো?’

হামি খালি (শুধু) চোখ দুটা চাহি, আর কিছু চাহি না। ‘হামি দেখতে চাহি, পড়তে চাহি। কেনে হামার জীবনটা আন্ধার হয়্যা গ্যালো?
মহরমী আক্তার, ককটেল বিস্ফোররণে আহত পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী

মহরমী আক্তার গণকা মহল্লার আশরাফুল ইসলামের মেয়ে। তিনি দুবাইপ্রবাসী একজন শ্রমিক। মহরমীর মা মাসকুরা খাতুন কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘মেয়েটা হামার একটা হাত হারাইলো, তাতেও কুনু দুঃখ নাই। যুদি একখান চোখ ফির‌্যা পায়, তাতেই জানে সাবুর দিতুং। লেখাপড়াটা করতে পারতোক। নাহিলে যে মেয়েটার জীবনখানটাই বাদ।’

মাসকুরা খাতুন আরও বলেন, দুর্ঘটনার আগে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ছিল তাঁর মেয়ে। এখন তাকে শুয়েই কাটাতে হয় সময়। মায়ের সহযোগিতা নিয়েই চলছে তার সব প্রাত্যহিক কাজকর্ম। সব সময়ই বিষণ্ন দেখা যায় তাকে। আর নীরবে চোখের পানি ফেলে।

মহরমীর দাদা আবদুল কাইয়ুম প্রথম আলোকে বলেন, মিরপুরের বাংলাদেশ আই হসপিটালে দুই দফা চিকিৎসা শেষে বর্তমানে মহরমীকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে আবারও ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। ককটেল বিস্ফোরণে মহরমীর এক চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। আর এক চোখের দৃষ্টি ফেরানোর ক্ষীণ আশা নিয়েই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘হামারঘে এত বড় ক্ষতি হইল, কিন্তু হামারঘে পাঞ্জরে এখুনো কেহু দাঁড়ায়নি। না সমাজ, না সরকার। পুলিশের বাদী হয়্যা করা মামলার আসামিরা হাইকোর্ট থ্যাকা জামিন পায়্যা ঘুইর‌্যা বেড়াইছে শুন্যাছি।’ চিকিৎসার ব্যয়ভারের জন্য রোববার সকালে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত আবেদন জানিয়েছেন বলে জানান তিনি।

হামারঘে এত বড় ক্ষতি হইল, কিন্তু হামারঘে পাঞ্জরে এখুনো কেহু দাঁড়ায়নি। না সমাজ, না সরকার। পুলিশের বাদী হয়্যা করা মামলার আসামিরা হাইকোর্ট থ্যাকা জামিন পায়্যা ঘুইর‌্যা বেড়াইছে শুন্যাছি।
আবদুল কাইয়ুম, মহরমীর দাদা

এলাকাবাসী জানান, স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুটি গ্রুপের মধ্যে বিবাদের জেরে এলাকায় কয়েক দফা ককটেল বিস্ফোরণের এলাকার শামীম নামে এক ব্যক্তিরও চোখ নষ্ট হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোজাফ্ফর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ককটেল বিস্ফোরণে মহরমীর কবজি উড়ে যাওয়া ও চোখ নষ্ট হওয়ার ঘটনায় এলাকায় বিবদমান দুটি পক্ষ দায় এড়াতে পারে না। পুলিশ বাদী মামলায় উভয় পক্ষের লোকজনকেই আসামি করা হয়েছে। এর আগে উভয় পক্ষের ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে আরও তিনটি মামলা করেছে। এদের কয়েকজন উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। অনেকেই পলাতক রয়েছেন। তবে উভয় পক্ষের আসামিদের মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।