হালকা বাতাসেই ভেঙে পড়েছে ‘দুর্যোগ সহনীয়’ বাড়িটি

নির্মাণের এক সপ্তাহের মধ্যেই  হালকা বাতাসে ভেঙে পড়েছে দুর্যোগসহনীয় বাড়িটি। ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার হুদা-শ্রীরামপুর গ্রামে।
প্রথম আলো

রান্নাঘর ও বাথরুমের ওপর দেওয়া টিনের চালটি পড়ে আছে পাশে। ঘর দুটির মেঝের সব প্লাস্টার উঠে গেছে। দেয়ালে দেখা দিয়েছে ফাটল। শোবার ঘরের মেঝের অনেক জায়গাও ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে গেছে। চালে দেওয়া কাঠের বাটামগুলোর জোড়া স্থান ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। নির্মাণকাজ শেষের সপ্তাহ না পেরোতেই হালকা বাতাসে এই অবস্থা হয়েছে ‘দুর্যোগসহনীয়’ বাড়িটির।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার মান্দারবাড়িয়া ইউনিয়নের হুদা-শ্রীরামপুর গ্রামের কৃষক মমিনুর রহমানকে বাড়িটি করে দেওয়া হয়েছিল। বাড়িটি নির্মাণে প্রায় ৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়, যার প্রকল্প সভাপতি ছিলেন ওই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শফিদুল ইসলাম। স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছেন, নিম্নমানের সামগ্রী ও কাজের কারণে বাড়িটি এখনই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে আছে।

কৃষক মমিনুরের বাড়ির দেয়ালে লাগানো প্রকল্পের ফলক
প্রথম আলো

ইউপি চেয়ারম্যান শফিদুল ইসলামের দাবি, বাড়িটির তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা হয়েছে। যেটুকু সমস্যা দেখা দিয়েছে তা ২-৩ দিনের মধ্যেই ঠিক করে দেবেন। অবশ্য প্রকৌশলী বেনজামীন বিশ্বাস জানান, তিনি এ সবের কিছুই জানেন না। ভেঙে পড়া বা মেরামতের বিষয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাঁর কোনো কথাও হয়নি।

সোমবার হুদা-শ্রীরামপুর গ্রামে মমিনুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ৬ শতক জমির ওপর থাকা এক কক্ষের মাটির একটি ঘরে তিনি বসবাস করেন। ঘরটির পেছনে দুই কক্ষের একটি পাকা ঘর তৈরি করা হয়েছে। সঙ্গে আছে একটি রান্নাঘর ও একটি বাথরুম। রান্নাঘর ও বাথরুমের ওপর দেওয়া টিনের চাল শোবার ঘরের সঙ্গে ঝুলে আছে। বাড়ির গৃহকর্তা মমিনুর রহমান দেখালেন, সদ্য নির্মাণ করা রান্নাঘর ও বাথরুমের মেঝের প্লাস্টার সব কীভাবে উঠে গেছে। মেঝেতে কোনো ঢালাই নেই, ভাঙাচোরা ইট পেড়ে তার ওপর হালকা সিমেন্ট-বালি ছিটিয়ে সমান করে দেওয়া হয়েছে। ঘরের ওপরে গাঁথুনিতেও ফাটল ধরেছে। শোবার ঘরের মেঝেও ভেঙেচুরে গেছে। কাঠের বাটামগুলো ঘন ঘন জোড়া দেওয়া হয়েছে। টুকরো টুকরো বাটাম কিনে জোড়াতালি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন সেই জোড়া থেকে খুলে যাচ্ছে। অনেক স্থানের কাঠ নষ্ট, হাত দিলেই খসে পড়ছে।

ছোট ছেলে রহমত আলীকে (১২) নিয়ে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী ওই মাটির ঘরে রাত কাটান। প্রতিবন্ধী ছেলেটি রান্না ঘরে ঘুমান। এই অবস্থা দেখে গ্রামের মানুষের অনুরোধে তিনি বাড়িটি পেয়েছিলেন। কিন্তু এতটা নিম্নমানের কাজ করা হয়েছে যে বাড়িটি কোনো কাজে আসছে না।
মমিনুর রহমান, উপকারভোগী কৃষক

মমিনুর রহমান জানান, প্রায় ৮ থেকে ৯ মাস আগে তাঁর এই বাড়ির নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। ইটের গাঁথুনি দিয়ে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়েছিল। এ সময় তিনি চেয়ারম্যান শফিদুল ইসলামের কাছে অনেকবার হেঁটেছেন, কিন্তু কাজ শুরু হয়নি। এক মাস হলো সেই ইটের গাঁথুনির ওপর টিনের চাল দিয়ে প্লাস্টার করে দেওয়া হয়েছে। আনুমানিক ১৫ দিন হয়েছে কাজটি শেষ করে সেখানে বসবাস করার জন্য বলেছেন চেয়ারম্যান শফিদুল ইসলাম। আরও জানিয়ে গেছেন, পরবর্তী সময়ে তিনি রঙের কাজটি করে দেবেন। কিন্তু কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার ৫ দিন পরই সামান্য বাতাসে বাড়িটির একাংশের টিনের চাল ভেঙে পড়েছে। ঘরের মধ্যের অবস্থা এতটা খারাপ যে সেখানে বসবাস করার কোনো উপায় নেই। তা ছাড়া ঘরটি দেখলে যে কেউ ভয়ে সেখানে বসবাস করবেন না। তিনিও ভয়ে ব্যবহার করছেন না। আবার বাড়িটি মেরামতের জন্য চেয়ারম্যানের কাছে গেলেও তিনি পাত্তা দিচ্ছেন না।

মমিনুর রহমান আরও জানান, তিনি পেশায় কৃষিশ্রমিক। অন্যের খেতে কামলা দিয়ে তাঁর সংসার চলে। মাঠে কোনো জায়গাজমি নেই। ভিটাবাড়ির ৬ শতকই তাঁর সম্বল। তিন সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে মুকুল হোসেন (২২) শারীরিক প্রতিবন্ধী। মেয়ে মমতাজ বেগমের (১৯) বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলে রহমত আলীকে (১২) নিয়ে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী ওই মাটির ঘরে রাত কাটান। প্রতিবন্ধী ছেলেটি রান্না ঘরে ঘুমান। এই অবস্থা দেখে গ্রামের মানুষের অনুরোধে তিনি বাড়িটি পেয়েছিলেন। কিন্তু এতটা নিম্নমানের কাজ করা হয়েছে যে বাড়িটি কোনো কাজে আসছে না। শুধু জায়গাটি নষ্ট হলো।

এ বিষয়ে মহেশপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের প্রকৌশলী বেনজামীন বিশ্বাস বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ পাওয়া সব কটি বাড়ি সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। মান্দারবাড়িয়া ইউনিয়নের দুটি বাড়ির এখনো রঙের কাজ বাকি রয়েছে। কিন্তু এভাবে একটি বাড়ি ভেঙে পড়েছে, এটা তাঁর জানা ছিল না। এখন তিনি বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবেন। তিনি জানান, যেহেতু অর্থবছর শেষ হয়ে গেছে, সে কারণে প্রকল্প সভাপতি এই কাজের বিল তুলে নিয়েছেন। তারপরও সভাপতির সঙ্গে কথা বলে সংস্কারকাজ করার ব্যবস্থা করবেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল্লাহ আল হেলাল জানান, তিনি জুলাই মাস থেকে দায়িত্বে আছেন। কাজটি তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার আগে হওয়ায় তিনি বিস্তারিত বলতে পারছেন না। তবে খোঁজখবর নিয়ে বিষয়টি দেখবেন।