হৃদয় মণ্ডলের পাশে থাকতে পঞ্চগড়, নাটোর থেকে এলেন তাঁরা

বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের জামিনের শুনানি দেখতে পঞ্চগড় ও নাটোর থেকে এসেছেন এই দুই শিক্ষক। ছবি আজ রোববার মুন্সিগঞ্জ আদালত চত্বরে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ধর্ম অবমাননার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তারের ১৯ দিন পর জামিন পেয়েছেন মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। আজ রোববার বেলা সোয়া একটার দিকে মুন্সিগঞ্জ জেলা অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক মুতাহারাত আক্তার ভূঁইয়া তাঁর জামিনের আদেশ দেন।

গত ২২ মার্চ ওই বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মো. আসাদ বাদী হয়ে হৃদয় চন্দ্রের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন। ওই দিনই তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারের পরদিন ২৩ মার্চ ও পরে ২৮ মার্চ আদালতে হৃদয় মণ্ডলের জামিন চাওয়া হয়েছিল। সে সময় আদালত তাঁর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। এরপরই বিষয়টি আলোচনায় আসে। হৃদয় মণ্ডলের মুক্তির দাবিতে ঢাকায় ও সিলেটে সমাবেশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও দেশের ১৮ বিশিষ্টজন তাঁর নিঃশর্ত মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।

আজ মামলার জামিন শুনানি দেখতে প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার দূর থেকে মুন্সিগঞ্জের আদালতে এসেছিলেন উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সাকোয়া উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক এবং ওই বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আশরাফুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল দুবার জামিন চেয়েছিলেন কিন্তু তাঁকে দেওয়া হয়নি। আজ তৃতীয় দফায় জামিন আবেদন করা হয়। আজ পঞ্চগড় থেকে এসেছি খুব আশা নিয়ে। আমাদের আশা পূরণ হয়েছে।’

শিক্ষক আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমি মনে করি, শুধু জামিনে মুক্তি নয়, ওনাকে সম্মানের সঙ্গে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া ও কর্মস্থলে ফিরিয়ে আনা দরকার। গণমাধ্যমের সাহায্যে সরকার যেহেতু জেনেছে এটি একটি মিথ্যা ও পরিকল্পিত ঘটনা, তাই শিক্ষককে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টিও দেখা উচিত সরকারের।’

নাটোর থেকে এসেছেন শিক্ষক মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী। তিনি বলেন, ‘অনেক দূর থেকে জামিন শুনানি দেখতে এসেছিলাম। জামিন হওয়ায় কষ্টটা সার্থক হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ওই শিক্ষককে মামলায় জড়ানো ও কারাগারে পাঠানোর পেছনে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা উচিত।

স্থানীয় সমাজ অনুশীলন কেন্দ্রের সংগঠক রঘু অভিজিৎ রায় বলেন, সরকার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে পারছে না। মানুষের মনকে একটি ঘটনা থেকে সরানোর জন্য এই রকম বহু ঘটনার দিকে ব্যস্ত রাখছে। মৌলবাদের সংকটকে সামনে এনে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংকটগুলোকে আড়াল করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা উচিত।

এর আগে গত ২৩ ও ২৮ মার্চ আদালতে হৃদয় মণ্ডলের জামিন চাওয়া হয়েছিল। সে সময় আদালত তাঁর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে ২২ মার্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মো. আসাদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। ওই দিনই হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করা হয়।

হৃদয় মণ্ডলের গ্রেপ্তারের ঘটনার বিষয়ে বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চবিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক প্রথম আলোকে জানান, ২০ মার্চ দশম শ্রেণির মানবিক শাখার বিজ্ঞানের ক্লাস নিচ্ছিলেন হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। সেখানে বিজ্ঞান ও ধর্ম বিষয়ে তাঁর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কয়েকজনের পক্ষে-বিপক্ষে কথোপকথন হয়। কোনো এক শিক্ষার্থী ওই কথোপকথনের ভিডিও ধারণ করে। পরবর্তী সময়ে প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দীনকে বিষয়টি জানানো হয়। প্রধান শিক্ষক সেদিনই হৃদয় চন্দ্রকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন এবং শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকতে বলেন। তবে শিক্ষার্থীরা স্থানীয় কয়েকজন ও প্রাক্তণ শিক্ষার্থীদের বিষয়টি জানায়। এর পরদিন সকালে তাঁরা বিদ্যালয়ে এসে ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তারের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

বিদ্যালয়টির ওই শিক্ষক বলেন, ‘আমিও এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। অনেক আগে থেকেই হৃদয় স্যারকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাঁর মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল। ধর্মান্ধতার বিষয়টি কখনো দেখিনি। তিনি কখনো কোনো ধর্মকে ছোট করে কথা বলতেন না। ধর্মীয় রীতিনীতি কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন না।’ তাঁর সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।