১৫ মাসে ৮০৮ শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যু

টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার পোস্টকামারী গ্রামের প্রতিবেশী দুই শিশু হাবিব (৩) ও সানিয়া (২)। একসঙ্গে খেলতে গিয়ে দুজনই বাড়ির পাশে ডোবার পানিতে পড়ে যায়। পরে শফিকুল মিয়ার ছেলে হাবিব ও ওহাব আলীর মেয়ে সানিয়াকে ডোবার পানি থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। গত বছরের ১৩ অক্টোবরের ঘটনা এটি।

পরের মাসে ৯ নভেম্বর ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার পশ্চিম পাঠানগড় গ্রামে পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায় বেলাল আহম্মেদের ছয় বছরের মেয়ে সুরাইয়া।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর এমন ঘটনা ভূরি ভূরি। কোনো কোনো পরিবার তাদের একাধিক সন্তান হারিয়েছে। গত ২০ আগস্ট নানার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যায় ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার আবদুল সিকদারেরডাঙ্গী গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ রাসেলের মেয়ে অমি (১৫) ও ছেলে তামীম (৮)।

বিভিন্ন সময়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি গণমাধ্যম ও যোগাযোগবিষয়ক বেসরকারি সংগঠন ‘সমষ্টি’র এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত ১৫ মাসে সারা দেশে ৯৬৮ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৮০৮। মোট মৃত্যুর মধ্যে ১১৮ জন নৌ দুর্ঘটনায় মারা গেছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের পক্ষে গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে সংগঠনটি এসব তথ্য জানিয়েছে।

নৌযান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটেছে গত বছরের ২৯ জুন। বুড়িগঙ্গা নদীতে এমএল মর্নিং বার্ড নামের একটি লঞ্চ ময়ূর-২ নামের আরেকটি বড় লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে যায়। এতে ৩২ জন মারা যায়। ৫ আগস্ট নেত্রকোনার মদন উপজেলায় হাওরে নৌকা ডুবে ১৭ জন মারা যায়।

নজরদারি ও সচেতনতার অভাব, সাঁতার না জানা এবং ডুবে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে এত বিপুলসংখ্যক শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

নজরদারির অভাবে শিশুমৃত্যু বেশি

সমষ্টির প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পানিতে ডুবে মারা যাওয়াদের মধ্যে ৮৩ শতাংশই শিশু। চার বছর বা কম বয়সী ৩৪৮ জন, ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ৩০৮ জন, ৯ থেকে ১৪ বছরের ১২০ জন এবং ১৫ থেকে ১৮ বছরের ৩২ জন মারা গেছে। ১৬০ জনের বয়স ১৮ বছরের বেশি। মোট মৃত্যুর মধ্যে ৭৮৩ শিশুর মৃত্যু হয়েছে পারিবারিক অসতর্কতা বা শিশুদের প্রতি নজরদারি না থাকার কারণে। ওই শিশুরা বড়দের অগোচরে বাড়িসংলগ্ন পুকুর বা অন্য জলাশয়ে চলে গেলে দুর্ঘটনার শিকার হয়।

সমষ্টির প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৫ মাসে বন্যার পানিতে ডুবে ৫৫ জন, মৃগীরোগ ও জলাতঙ্ক থেকে পানিতে ডুবে ৬ জন, নদীতে ঝাঁপ দিয়ে বা খেলতে গিয়ে ৩ জন, অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে ১ জন এবং পানির ট্যাংকে ডুবে ২ জন নিহত হয়।

সমষ্টির পরিচালক মীর মাসরুর জামান প্রথম আলোকে বলেন, দিনের একটি সময়ে মা–বাবা দুজনই কাজে ব্যস্ত থাকেন। সেই সময়ে শিশুরা সঙ্গীহীন থাকে বা কারও নজরে থাকে না। অনেক সময় ওই শিশুদের দেখভালের দায়িত্ব থাকে তার চেয়ে কিছু বড় ভাই-বোনের। আবার গ্রামে জলাশয় বেশি। ফলে ওই শিশুরা পানিতে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। তিনি বলেন, পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে গ্রামেও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাঁতার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।

সমষ্টির প্রতিবেদন অনুসারে, একাধিক স্বজন হারিয়েছে ৭০টি পরিবার। গত ১৫ মাসে ৭০টি পরিবারের ১৮৪ জন সদস্য পানিতে ডুবে মারা গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অপঘাতজনিত কারণে বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর ৪৩ শতাংশ ঘটে পানিতে ডুবে। যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশনের (আইএইচএমই) ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ১৪ হাজার ২৯ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে। ওই প্রতিবেদন অনুসারে পানিতে ডুবে মৃত্যুর দিক থেকে কমনওয়েলথভুক্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।

অঞ্চল ও সময়ভেদে মৃত্যুর হেরফের

সমষ্টির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ মাসে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ঢাকা বিভাগে (২১১ জন)। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ১৮৪ জন, রংপুরে ১৪৩, রাজশাহীতে ১২১, ময়মনসিংহে ১০৬, বরিশালে ৮৩ ও খুলনা বিভাগে ৭২ জন মারা গেছে। এ সময়ে সবচেয়ে কম মৃত্যু ছিল সিলেট বিভাগে, ৪৮ জন। সকালের দিকে সবচেয়ে বেশি ৩৯৪ জন এবং দুপুরে ৩৮৮ জন মারা গেছে। বাকিরা অন্য সময়ে মারা গেছে।

ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশ দেশের ১০টি উপজেলায় দুই হাজার দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করছে এবং ২০০৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাঁশ দিয়ে জলাশয় ঘিরে বিশেষ পদ্ধতিতে ২০টি উপজেলার ৭ লাখ শিশুকে সাঁতার প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সংগঠনটির তথ্য অনুসারে, সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে (৬০ শতাংশ)। ৮০ শতাংশ মৃত্যু হয় পুকুর ও ডোবায়। এ ছাড়া জাতীয় পর্যায়ের চেয়ে গড়ে তিন গুণ বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে বরিশাল বিভাগে। সারা দেশে লাখে ১২ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। আর বরিশালে লাখে ৩৯ জন পানিতে ডুবে মারা যায়।

আইডিআরসি বাংলাদেশের পরিচালক আমিনুর রহমান পানিতে ডুবে যাওয়ার বিষয়ে সুইডেনে পিএইচডি করেছেন। দেশে কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় মৃত্যুর সংখ্যা কমানো সম্ভব। গ্রামে বাড়ির ৪০ কদমের মধ্যে পুকুর থাকে। সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত গ্রামের শিশুদের জন্য দিবাযত্নে রাখলে বিপুলসংখ্যক মৃত্যু ঠেকানো যাবে। সাঁতার প্রশিক্ষণে প্রতিরোধ করা যাবে ৯৬ শতাংশ মৃত্যু। তিনি আরও বলেন, পানিতে ডুবলে প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়ে জানেন না অধিকাংশ মানুষ। ডুবে গেলে যেহেতু শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা হয়, ডুবে যাওয়া শিশু বা ব্যক্তির মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিতে হবে এবং হৃৎপিণ্ড বরাবর চাপ দিতে হবে। মাত্র দুই দিনের প্রশিক্ষণে সাত বছরের একটি শিশুকেও এটা শেখানো সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।