‘২ হাজার ২০০ টাকা বেতন পাই, এই দিয়ে কি চলে’
কোলাহলময় রংপুর নগরের চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ। ব্যস্ত নগরের বাসাবাড়ির মানুষ তখনো ঘুমের রাজ্যে। একটি–দুটি করে অটোরিকশা চলাচল করছে। উচ্চ স্বরে গাড়ির কোনো হর্ন নেই। হইহুল্লোড়–ছুটোছুটির বিন্দুমাত্র রেশও নেই। ঠিক এমন সময় পাখির কিচিরমিচির শব্দে তাঁদের ঘুম ভাঙে। শরীরের অলসতা দূর করে তাঁরা ছুটে যান সড়কে। নগর পরিচ্ছন্নতার কাজে নেমে পড়েন। তাঁদের হাতের ছোঁয়ায় শহর হয়ে ওঠে পরিচ্ছন্ন।
রংপুর নগরের প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন পাড়ামহল্লার সড়কের মধ্যে প্রতিদিন ময়লা–আবর্জনা জমে যায়। সড়কের দুই পাশ নোংরা হয়ে ওঠে। নোংরা নগরকে পরিচ্ছন্ন করতে প্রতিদিনের মতো তাঁদের ছুটে চলার যেন শেষ নেই। কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না তাঁদের। আছে দুঃখ-কষ্ট। অভাব-অনটন।
রোববার ভোরের দিকে নগরের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সড়কের দুই পাশ ঝাড় দিচ্ছেন। জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করছেন। আবার কেউ এসব ময়লা ছোট ছোট ঠেলা ট্রলিতে তুলছেন। কেউবা সড়কের মাঝখানের ডিভাইডারের বেড়ে ওঠা ঘাস পরিষ্কার করতে ব্যস্ত।
নগরের বেতপট্টি এলাকায় ঝাড় দিতে দিতে দেখা মিলল দোলনা বেগমের। বয়স ৬০ পেরিয়েছে। স্বামী ২০ বছর আগে মারা গেছেন। থাকেন নগরের কুকরুল এলাকায়। চার ছেলেমেয়ের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এক ছেলে তাঁর সঙ্গে থাকেন। করেন দিনমজুরি। আরেক ছেলে আলাদা থাকেন। ঝাড় দিতে দিতে বলেন, ‘১৬ থেকে ১৭ বছর থাকি শহরের রাস্তা ঝাড় দিই। পরিষ্কার করি। মাসে দুই হাজার টাকা পাই সিটি করপোরেশন থাকি। এই টাকা দিয়া কি সংসার চলে? মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করি। ঈদোত এলাও কোনো শাড়ি পাই নাই।’
কলেজ রোড এলাকায় খামার মোড়ে দুই নারীকে সড়কে ঝাড় দিতে দেখা যায়। তাঁদের মধ্যে বাবুপাড়ার বাসিন্দা মোমেনা বেগম জানান, তাঁর স্বামী নেই। দুই ছেলেমেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিলেও ছেলে আলাদা থাকেন। এবাড়ি-ওবাড়ি কাজ কাজ করে তাঁর খাবার জোটে। কত বছর থেকে শহরে এভাবে রাস্তা ঝাড় দিয়ে আসছেন, তা জানতে চাইলে বলেন, ‘ঠিক মনে নাই। তবে মেলা বছর থাকি এই কাজ করি আসতোছি। রাস্তার ময়লা পরিষ্কার করিয়া সিটি করপোরেশন থাকি ২ হাজার ২০০ টাকা পাই।’ তিনি আরও বলেন, সকাল সকাল শহরটা পরিষ্কার করলে মনটাও ভালো হয়া যায়। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা আরেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী মরিয়ম বলেন, ‘ঈদোত সিটি করপোরেশন থাকি টাকা পাছি। সেই টাকা দিয়া সেমাই কিনমো। ঈদের দিন সেমাই খামো।’
নগরের জিলা স্কুল মোড় থেকে বাংলাদেশ মোড় পর্যন্ত দুজনকে দেখা যায় সড়কের ডিভাইডারের মধ্যে গজিয়ে ওঠা ঘাস পরিষ্কার করছেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন তোজাম্মেল হোসেন। বাড়ি নগরের পানবাড়ি এলাকায়। তিনি এ কাজ করে আসছেন দীর্ঘ ১২ বছর থেকে। চার ছেলেমেয়ের মধ্যে এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তিন ছেলে স্কুলে পড়াশোনা করছেন। এভাবে সকালে শহর পরিচ্ছন্নতার কাজ করে কেমন লাগে, তা জানতে চাইলে বলেন, ‘কষ্ট হলেও ভালোই লাগে। শহরটা পরিষ্কার করলে মনটাও পরিষ্কার থাকে।’ আরও বলেন, ‘প্রতিদিন ভোরে উঠতে হয়। সূর্য উঠতে না উঠতেই এ কাজে নেমে পড়তে হয়।’
জিলা স্কুল মোড়ে ঝাড় দিয়ে রাস্তার ময়লা সরাতে ব্যস্ত গুলনাহার। তিনি বলেন, ‘স্বামী নেই। অনেক বছর হলো মারা গেছেন। ছেলেমেয়ে থাকলেও তারা সঙ্গে থাকে না। সিটি থাকি মাত্র ২ হাজার ২০০ টাকা পাই। এই টাকা দিয়ে কি চলে?’
রংপর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ভোরে ৩৫০ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নগরের ৩৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২২টি ওয়ার্ডে রাস্তা ঝাড় দেওয়ার কাজ করেন। বাকি ১১টি ওয়ার্ডে এখনো এ কাজ শুরু হয়নি। সেই সঙ্গে সব মিলিয়ে ৭০০ পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রতিদিন সকালে ট্রলি ও ট্রাকে করে বর্জ্য অপসারণ কাজে নিয়োজিত।