‘২৫ বছর পর ধান ওঠালাম’

ইটভাটার কারণে গত ২৫ বছর জেলার ১০টি গ্রামে ধান বা কোনো ধরনের কৃষির আবাদ ছিল না। ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়ায় আবার কৃষি আবাদ শুরু হয়েছে।

গাজীপুর জেলার মানচিত্র

‘বাড়ির পাশে তিন বিঘা দুই ফসলি আবাদি জমি রয়েছে। কিন্তু ইটভাটার কারণে কোনো ফসলই চাষাবাদ করতে পারিনি। ইটভাটার মালিকেরা ভাড়াও নেননি। এবার ইটভাটা নেই, তাই পুরোটাই চাষাবাদ করেছি। ফলনও অনেক ভালো হয়েছে। প্রায় ২৫ বছর পর নিজের ৩ বিঘা জমির খেতের ধান কেটে ঘরে ওঠালাম।’

কথাগুলো বলছিলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাতলাখালী এলাকার বাসিন্দা বাদল মিয়া। শুধু বাদল মিয়া নন, আশপাশের ১০টি গ্রামের শতাধিক কৃষক দীর্ঘদিন পর এবার চাষাবাদ করেছেন।

উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর ও ২০২০ সালে সিটি করপোরেশন এলাকায় অবৈধ ইটভাটাবিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। পরে ওই সব এলাকার ইটভাটাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
মো. আবদুস সালাম সরকার, উপপরিচালক, গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তর

গাজীপুরে ১০ গ্রামের কৃষক প্রায় ২৫ বছর পর খেতের ধান ঘরে তুললেন। ইটভাটার কারণে গত ২৫ বছর ওই সব এলাকায় ধান বা কোনো ধরনের কৃষির আবাদ ছিল না। ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়ায় আবার কৃষি আবাদ শুরু করা হয় এবং কৃষকের ঘরে ওঠানো হচ্ছে ধান।

এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বাইমাইল, কাতলাখালী, রাজাবাড়ী, আহাকী, বাঘিয়া, জয়েরটেক, আমবাগ, কারখানা বাজার, কাউলতিয়া, ইসলামপুরসহ ১০টি এলাকায় গড়ে ওঠে শতাধিক ইটভাটা। এর পাশাপাশি গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় শত শত ইটভাটা গড়ে ওঠে। কিন্তু ওই এলাকায়গুলোয় ইটভাটার কারণে কৃষিজমি কমে যায় এবং ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় পুরো এলাকা কৃষিশূন্য হয়ে পড়ে। ধুলাবালু ও কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকত ওই সব এলাকার পরিবেশ। ইটভাটার ওই সব এলাকায় কোনোরকম কৃষি আবাদ ও চাষাবাদ করা হতো না। কিন্তু ২০১৯ ও ২০২০ সালে গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর যৌথ অভিযান চালিয়ে ওই সব এলাকার সব ইটভাটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এ কারণে বন্ধ হয়ে যায় ইটভাটা। ইটভাটা না থাকায় চলতি বছরের বোরো মৌসুমে এলাকার কৃষকেরা আবার ধান চাষসহ বিভিন্ন ফলের আবাদ শুরু করেন। এখন সেই পাকা ধানের গন্ধ পুরো এলাকায়।

সম্প্রতি ওই সব এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, ইটভাটা না থাকলেও ইটভাটার সুউচ্চ চিমনিগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশের আবাদি জমিতে কৃষকেরা ধান কাটছেন। অনেকেই খেতের মধ্যে পাটি বিছিয়ে সেখানেই ধান মাড়াই করছেন। এলাকাগুলোয় এখন ধানকাটার উৎসবমুখর পরিবেশ চলছে।

গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুসারে সিটি করপোরেশন এলাকায় ইটভাটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত ইটভাটার সব স্থাপনা সরিয়ে নিতে ইটভাটার মালিকদের চিঠি দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু ভাটার মালিকেরা উচ্চ আদালতে রিট করে ১৭৪টি ইটভাটা পরিচালনা করছিলেন। একপর্যায়ে ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর অবৈধ ইটভাটা বন্ধ ও উচ্ছেদের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। পরে ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ১৬ মার্চ পর্যন্ত অবৈধ ইটভাটাবিরোধী ২৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এ সময় ফায়ার সার্ভিস দিয়ে ইটভাটার আগুন নিভিয়ে ১১২টি ইটভাটা ভেকু দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওই সব ইটভাটার মালিককে ৪ কোটি ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

এ ব্যাপারে গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবদুস সালাম সরকার বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর ও ২০২০ সালে সিটি করপোরেশন এলাকায় অবৈধ ইটভাটাবিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। পরে ওই সব এলাকার ইটভাটাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে কৃষকেরা আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছেন।