৩,১০০ প্রাণীর জন্য চিকিৎসক একজন

হাসপাতালের নিবিড় চিকিৎসার জন্য নেই তেমন লোকবল। তাই বেশির ভাগ সময় ফাঁকা থাকে অপারেশন থিয়েটারছবি: প্রথম আলো

ভবনটি জরাজীর্ণ। যন্ত্রপাতিতে ধুলা জমেছে। ৩ হাজার ১০০টি প্রাণীর জন্য চিকিৎসক মাত্র একজন। রেডিওলজিস্ট, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট ও অ্যানেসথেসোলজিস্টের পদ রয়েছে, তবে জনবল নেই। রোগ শনাক্তের ব্যবস্থায়ও রয়েছে ঘাটতি।

এই হাল দেশের জাতীয় চিড়িয়াখানার ভেতরে থাকা প্রাণীদের চিকিৎসার ভেটেরিনারি হাসপাতালের। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চিকিৎসাসুবিধা ও জনবলের ঘাটতির কারণে চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না।

চিড়িয়াখানার পরিচালক মো. আবদুল লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের কান, চোখসহ প্রায় সব অঙ্গের জন্য আলাদা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছে। অথচ চিড়িয়াখানায় বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর জন্য একজন চিকিৎসক রয়েছেন। ফলে সমস্যা তো হবেই। চিড়িয়াখানায় শাখাভিত্তিক হলেও আলাদা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন।

অবশ্য আবদুল লতিফ উল্লেখ করেন, চিড়িয়াখানা নিয়ে মহাপরিকল্পনার কাজ চলছে। সেটি বাস্তবায়িত হলে দক্ষ জনবল বাড়ানো সম্ভব হবে এবং হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রসহ (আইসিইউ) চিকিৎসার বিভিন্ন আধুনিক ব্যবস্থা থাকবে।

ঢাকার মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানাটি প্রায় ১৮৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ১৯৭৪ সালের ২৩ জুন মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানা দর্শনার্থীদের জন্য প্রথম উন্মুক্ত করা হয়। এখন নগরবাসীর বিনোদনকেন্দ্রের মধ্যে এটি অন্যতম। বিশেষ করে বহু পরিবার বন্য প্রাণী দেখাতে শিশুদের সেখানে নিয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, করোনাকালে এখন দিনে ১০ থেকে ১২ হাজার দর্শনার্থী চিড়িয়াখানায় যান।

জাতীয় চিড়িয়াখানায় যে তিন হাজারের বেশি প্রাণী রয়েছে। এর একটি বড় অংশ বিপুল ব্যয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে কিনে আনা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, একেকটি বাঘ কিনতে ২৫ লাখ টাকা লেগে যায়। ফলে একেকটি প্রাণীর মৃত্যু মানে আর্থিক দিক দিয়েও বড় ক্ষতি।

জাতীয় চিড়িয়াখানার ভেটেরিনারি হাসপাতালের করুণ দশার বিষয়টি সামনে এসেছে প্রাণীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। এই চিড়িয়াখানায় গত ৩০ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত আটটি প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে সিংহ, বাঘশাবক, জিরাফশাবক, ওয়াইল্ড বিস্ট ও ইম্পালা। এ ছাড়া গাজীপুরের শ্রীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে সম্প্রতি ১১টি জেব্রা, ১টি বাঘ ও ১টি সিংহীর মৃত্যু হয়েছে।

প্রাণীর মৃত্যু নিয়ে শোরগোলের মধ্যে গত ৩০ জানুয়ারি জাতীয় চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখা যায়, ভেটেরিনারি হাসপাতালটিতে অপারেশন থিয়েটার, এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাম ও অ্যানেসথেসিয়া কক্ষ রয়েছে। নামকাওয়াস্তে আছে প্রাণীর রোগ পরীক্ষাগার বা জু অ্যানিমেল ল্যাবরেটরি। ময়নাতদন্ত ও অস্ত্রোপচারের পর প্রাণীকে রাখার জন্য আলাদা কক্ষও দেখা গেল। তবে অপারেশন থিয়েটারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে ধুলো জমেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দক্ষ জনবল ও ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর জন্য উপযোগী যেসব যন্ত্রপাতি দরকার, তা হাসপাতালটিতে নেই। তাই শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।

হাসপাতালটির একমাত্র চিকিৎসক ভেটেরিনারি সার্জন নাজমুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধরুন, জিরাফের কিছু হলো। সেটিকে তো আর হাসপাতালে এনে এক্স-রে করা যাবে না। এর জন্য বহনযোগ্য যন্ত্র লাগবে, যা দিয়ে খাঁচার ভেতরে পরীক্ষা করা যাবে।’

ভর্তি বানর, খরগোশ ও মেছো বিড়াল

জাতীয় চিড়িয়াখানার হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি দেখা গেল কয়েকটি প্রাণী—একটি বানর, দুটি খরগোশ ও একটি মেছো বিড়াল। তবে বানর ও বনবিড়ালটি অসুস্থ নয়। চিড়িয়াখানার একজন কর্মী জানান, বানরটি খাঁচায় অন্য বানরদের উত্ত্যক্ত করে। এ অপরাধে সেটিকে হাসপাতালে এনে আলাদা করে রাখা হয়েছে।

মেছো বিড়ালটি চিড়িয়াখানায় এসেছে উপহার হিসেবে। আপাতত সেটিকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। শুধু খরগোশ দুটির চিকিৎসা চলছে। হাসপাতালটির অন্যান্য খাঁচা ফাঁকা।

খাঁচায় রাখা একটি বানর। সম্প্রতি চিড়িয়াখানায় ভেটেরিনারি হাসপাতালে
প্রথম আলো

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, সেখানে ৭০টি প্রাণী আছে, যেগুলোর এখনকার বয়স স্বাভাবিক আয়ুষ্কালের বেশি। প্রদর্শনীর অযোগ্য হয়ে গেলে সেগুলোকে আলাদা করে রাখা হবে। চিড়িয়াখানার জন্য আইন না থাকায় বয়স্ক প্রাণীর ‘নো পেইন’ বা ব্যথাহীন মৃত্যু নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। গত বছরের ৯ আগস্ট বাংলাদেশ চিড়িয়াখানা আইন, ২০২১-এর অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। তবে এখনো পাস হয়নি।

জাতীয় চিড়িয়াখানায় বর্তমানে একটি আফ্রিকান সিংহ ও একটি গন্ডার সঙ্গীর অভাবে বিষণ্নতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। নতুন প্রাণী কেনার উদ্যোগও আছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদেশ থেকে আফ্রিকান সিংহ, রেড ক্যাঙারু, লামা, পেলিক্যান ও নীল ওয়াইল্ড বিস্ট কেনার জন্য দুই বছর ধরে দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে।

১০০ পদে জনবল নেই

জাতীয় চিড়িয়াখানায় জনবলকাঠামোয় অনুমোদিত পদ ২৩৭টি। এখন জনবল আছে ১৪০ জন। অর্থাৎ প্রায় ১০০টি পদ শূন্য। ফলে এখন যাঁরা কর্মরত, তাঁদের একাধিক পদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, চিড়িয়াখানায় কাজ করে তাঁদের জীবনে ঈদ বা আনন্দ বলতে কিছু নেই। ছুটিও পাওয়া যায় না। কর্মীদের জন্য ঝুঁকিভাতাও নেই। যদিও হিংস্র প্রাণীর খাঁচার ভেতর ঢোকা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনোকলজি, অবসটেট্রিকস অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ বিভাগের অধ্যাপক আ ন ম আমিনুর রহমান বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্য প্রাণী বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষিত এই দক্ষ জনবলকে চিড়িয়াখানায় কাজে লাগাতে হবে। চিড়িয়াখানার মতো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরাই যাতে পদোন্নতি পেয়ে সর্বোচ্চ স্তরে যেতে পারেন, তারও ব্যবস্থা করতে হবে।

‘জবাবদিহি থাকতে হবে’

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জাতীয় চিড়িয়াখানা এবং রংপুর চিড়িয়াখানার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। মহাপরিকল্পনা তৈরির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশ্বের শতাধিক চিড়িয়াখানার পরিকল্পনাকারী বার্নার্ড হ্যারিসন। এটি জুনের মধ্যে অনুমোদিত হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মহাপরিকল্পনায় যেসব বিষয় থাকছে, তা বাস্তবায়নে দেড় হাজার কোটি টাকা লাগতে পারে। কাজ করতে লাগবে পাঁচ থেকে ছয় বছর। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বিভিন্ন সময় বলেছেন, মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্ত থেকে মানুষ আসবে বাংলাদেশের চিড়িয়াখানা দেখতে।

অবশ্য সম্প্রতি প্রাণীর মৃত্যু ও চিড়িয়াখানার হাসপাতালের দুরবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খান প্রথম আলোকে বলেন, চিড়িয়াখানা বা সাফারি পার্কে বন্য প্রাণী মারা যেতেই পারে। তবে যেভাবে মারা যাচ্ছে, তা ব্যতিক্রম। চিড়িয়াখানায় মানসম্পন্ন পরিচালন পদ্ধতি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর) থাকতে হবে। কখন কোন প্রাণীর কী রোগ হলো, রক্তের নমুনা কতবার পরীক্ষা হলো, ফলাফলে কী এসেছে—এ ধরনের সব তথ্য থাকা দরকার।

রেজা খান মনে করেন, যেখানে যত বন্য প্রাণী আছে, তাদের জন্য আলাদা একটি বিভাগ থাকা জরুরি। মূল কথা বন্য প্রাণী রক্ষায় জবাবদিহি থাকতে হবে।