৪ গ্রামের ভরসা এক নলকূপ

উপজেলার গুটুটিয়া ইউনিয়নের চারটি গ্রামের মানুষের সুপেয় পানির ভরসা একটি নলকূপ। সেখান থেকে ছয় হাজার মানুষ খাওয়ার পানি সংগ্রহ করে।

চার গ্রামের একটি নলকূপেই মেলে সুপেয় পানি। সারা দিন বা সপ্তাহ ধরে খাওয়ার জন্য সে পানি নিতে কলপাড়ে ভিড় করেন নারীরা। গত মঙ্গলবার ডুমুরিয়ার লাইন বিল পাবলা গ্রামে
সাদ্দাম হোসেন

ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাতটা ছুঁই ছুঁই। কুয়াশার চাদর ভেদ করে সূর্য একটু একটু করে রোদ ছড়াতে শুরু করেছে খুলনার ডুমুরিয়ার লাইন বিলপাবলা গ্রামের রাস্তায়। ইট বিছানো পথ ধরে টান পায়ে হাঁটছিলেন রনজিতা মণ্ডল। শীর্ণ শরীরের চল্লিশোর্ধ্ব ওই নারীর হাতে ও কাঁখে চারটি কলস। রনজিতা এসে থামলেন বিলপাবলা লাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রবেশপথের সামনে। সেখানে নারীদের বড়সড় জটলা। যত মানুষ, তাঁর চেয়ে বেশি কলসের সারি। সেই সারিতে নিজের কলস রাখলেন রনজিতা। সাতসকালে একটি কলের পাড়ে রনজিতার মতো জনা চল্লিশেক নারীর জড়ো হওয়ার কারণ পরিবারের জন্য সুপেয় পানি সংগ্রহ করা।

ডুমুরিয়ার গুটুটিয়া ইউনিয়নের শিকদার পাড়া, কাচনাপাড়া, লাইনবিল পাবলা ও ক্ষত্রিয়পাড়া—এই চার গ্রামের মানুষের সুপেয় পানির ভরসা ওই নলকূপ। কম করে হলেও ছয় হাজার মানুষের তেষ্টা মেটায় নলকূপটি।

রনজিতা জানান, পরের জমিতে কাজ করে তাঁদের সংসার চলে। যেদিন কাজ থাকে না, সেদিন সকালে পানি নিতে আসেন। কাজ থাকলে আসেন সন্ধ্যায়। গতকাল বুধবার তিনি পানি নিতে ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে এসেছিলেন। কচুরিপানায় পূর্ণ খালে নৌকা কলপাড় পর্যন্ত আসে না। সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার পানি নিতে আসেন তিনি। চেষ্টা করেন একসঙ্গে সব কলস ভরে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু এতে বেশি সময় লাগায় অন্যরা রাগ করেন। রনজিতা বলেন, কলসের দীর্ঘ সারি থাকলে বসে থাকতে হয়। দিনের অনেকটা সময় চলে যায় পানি নিতে এসে।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্কুলবাড়ির ওই কলপাড়ের জটলায় যোগ হতে থাকে নতুন নতুন মুখ। কারও হাতে একটি-দুটি আবার তিনটির বেশি কলসও থাকে। সঙ্গে প্লাস্টিকের বিভিন্ন বোতল ও জার তো আছেই। সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পানি সংগ্রহ করেন তাঁরা। কেউ পুরো সপ্তাহের, কেউ বা দুই–এক দিনের জন্য।

পানি নিতে আসা নারীদের মধ্যে সারিতে দাঁড়ানো নিয়ে ঝগড়া হয়, চুল টানাটানির ঘটনাও ঘটে মাঝেমধ্যে। আবার এই কলপাড়েই চার গ্রামের সব খবর মেলে।
অনামিকা বিশ্বাস, বিলপাবলা গ্রামের বাসিন্দা

গতকাল বুধবার সকাল পৌনে সাতটা থেকে বেলা সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ওই কলপাড়ে অবস্থান করে দেখা যায়, দূর থেকে আসা নারীদের অনেকেই সঙ্গে নিয়ে এসেছেন শিশুদের। আশপাশের নারীরা টুথব্রাশ মুখে নিয়েই কলপাড়ে হাজির। নিজের কলস ভরার পাশাপাশি অন্যজনেরটাও ভরে দিচ্ছেন। পানি নেওয়া লোকজনের মধ্যে ৮ বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধাও আছেন। সারিতে দাঁড়ানো নিয়ে তাঁদের কথা–কাটাকাটিও হলো এক দফায়। পাশাপাশি চলল বারোমিশালি গল্প।

কলপাড়ে দাঁড়িয়ে লাইন বিলপাবলা গ্রামের অনামিকা বিশ্বাস জানান, ফজরের আজানের সময় থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কলপাড়ে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। কলটার কোনো বিরাম নেই। পানি নিতে আসা নারীদের মধ্যে সারিতে দাঁড়ানো নিয়ে ঝগড়া হয়, চুল টানাটানির ঘটনাও ঘটে মাঝেমধ্যে। আবার এই কলপাড়েই চার গ্রামের সব খবর মেলে।

কাচনাপাড়া গ্রামের চিত্রা, পূর্ণিমা, সিমলা, স্বর্ণা, অনন্যা নামে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া কিশোরীদের একটি দল পানি নিতে এসেছিল গতকাল সকালে। চিত্রা বিশ্বাস বলল, রায়ের মহল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে সে। তাদের পরিবারে আটজন সদস্য। প্রতিদিন তিন কলস পানি লাগে। সে আর তাঁর বোন মিলে পানি নিয়ে যায়।

পানি নিতে আসা আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করেন মূলত নারীরা। তবে পুরুষেরাও আসেন। যদি কোনো কারণে পরিবারের নারী সদস্য আসতে না পারেন তখন পুরুষ সদস্যকে আসতে হয়। সরকারি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে গ্রামগুলোর বিভিন্ন জায়গায় নলকূপ স্থাপন করা হলেও তাতে মিঠাপানি ওঠে না। একমাত্র লাইন বিলপাবলা স্কুলের নলকূপটিতেই খাবার উপযোগী পানি মেলে। ২০১৯ সালের শেষ দিকে এলাকার এক ব্যক্তি নলকূপটি স্থাপন করেন।

ডুমুরিয়া উপজেলার জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী পৃথ্বীশ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, সরকারিভাবে ১ হাজার ২০০ ফুট গভীর নলকূপ স্থাপন করেও মিঠাপানি পাওয়া যায়নি। ব্যক্তি উদ্যোগে ১ হাজার ৪৪০ ফুট গভীর নলকূপে সুফল পাওয়া গেছে। সরকারিভাবেও এমন গভীর নলকূপ স্থাপনের প্রকল্প নেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।