৪৭ বছর পর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন তাঁরা

একাত্তরের ভয়াল স্মৃতি মনে করে এখনো আঁতকে ওঠেন যোগমায়া মালো। ৫০ বছর ধরে শরীর ও মনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। ৪০ বছর ধরে অন্যের আশ্রয়ে আছেন। তবে শেষ জীবনে সান্ত্বনা একটাই রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন।

যোগমায়া মালোর বাড়ি শরীয়তপুর সদরের দক্ষিণ মধ্যপাড়া গ্রামে। তাঁর মতো শরীয়তপুরের আরও চারজন ২০১৮ সালে নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁরা হলেন গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুরের ভানু বিবি, সদর উপজেলার দক্ষিণ মধ্যপাড়া গ্রামের যুগলবালা পোদ্দার ও মধ্যপাড়া গ্রামের সুমিত্রা মালো।

১৯৭১ সালে ১৫ বছরের কিশোরী বধূ ছিলেন যোগমায়া মালো। একাত্তরের স্মৃতি মনে এলে এখনো তাঁর চোখে জল আসে। চোখের জল মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ‘২২ মে আমাদের গ্রামসহ আশপাশের হিন্দুপাড়ায় পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায়। স্বামী পদ্মা নদীতে মাছ শিকার করতে গিয়েছিলেন। একা বাড়ি ছেড়ে পালাতে সাহস পাইনি। বসতঘরেই ছিলাম। ২৩ মে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা তাঁকে ঘর থেকে জোর করে নিয়ে যায়।’

যোগমায়াসহ ৩০-৩৫ নারীকে নেওয়া হয় মাদারীপুর এআর হাওলাদার জুট মিলে। সেখানে আটকে রেখে তাঁদের নির্যাতন করা হয়। পাঁচ দিন পর সেখান থেকে ছাড়া পান যোগমায়া। পরে স্বামীকে খুঁজে পান। একাত্তরের ওই নির্যাতনের স্মৃতি এখনো তাড়া করে তাঁকে। এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তাঁর স্বামী মারা গেছেন প্রায় ৩০ বছর আগে। বর্তমানে অন্যের আশ্রয়ে রয়েছেন তিনি।

ভানু বিবির বাড়ি গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুরে। বর্তমানে তিনি থাকেন ঢাকার মিরপুরের গরিবে নেওয়াজ বস্তিতে। গত ৫০ বছরই কেটেছে তাঁর দুঃখ, কষ্ট ও অবহেলায়। সম্প্রতি মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরু হলে গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন তিনি। বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র ও খবর পৌঁছে দিতেন। এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালায়। সেখানেই তাঁকে আটক করে সেনারা। মুক্তিযোদ্ধা ও অস্ত্রের সন্ধান জানতে চায় তারা। বেয়োনেট দিয়ে তাঁর শরীর ক্ষতবিক্ষত করে। পরে তিনি ছাড়া পান।

ভানু বিবির স্বামী রোস্তম ব্যাপারীও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি মারা যান। এরপর চার শিশুসন্তান নিয়ে ভানু বিবি ঢাকায় চলে যান। বস্তিতে আশ্রয় নেন। এখন অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। সেই কষ্টের জীবন এখনো বয়ে চলেছেন তিনি।

স্বাধীনতার পর বেঁচে থাকার জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছে। মা–ও অনেক কষ্ট করেছেন। দুঃখ একটাই, মা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেখে যেতে পারলেন না।
বীনা রানী মালো, সুমিত্রা মালোর মেয়ে

যুগলবালা পোদ্দার, তাঁর স্বামী গৌরাঙ্গ চন্দ্র পোদ্দার ও দেবর নৃপেন চন্দ্র পোদ্দারকে ২৩ মে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। তাঁর স্বামী ও দেবরকে হত্যা করা হয়। চার দিন নির্যাতনের পর মুক্তি পান যুগলবালা। মুক্তিযুদ্ধের পর শিশুসন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। অভাব-অনটনে সন্তানদের পড়ালেখা করাতে পারেননি। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই ২০১১ সালে মারা যান যুগলবালা। তাঁর এক সন্তান রতন পোদ্দারের গ্রামে চায়ের দোকান রয়েছে। আরেক ছেলে তপন পোদ্দার খুলনায় সবজি বিক্রি করেন।

রতন পোদ্দার বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স আট বছর। মা বন্দিদশা থেকে ফিরে অনেক দিন কথা বলতে পারেননি। স্বাধীনতার জন্য আমাদের পরিবারকে অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু ৫০ বছর ধরে স্বাধীন দেশে আমরা চরম অবহেলিত।’

১৯৭১ সালে সুমিত্রা মালো অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২৩ মে তাঁকে ও তাঁর তিন সন্তানকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। তাঁদের বসতঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তিন দিন আটকে রেখে তাঁদের নির্যাতন করা হয়। ছাড়া পাওয়ার পর তাঁরা অন্যের আশ্রয়ে থাকতে শুরু করেন। স্বাধীনতার ১০ বছর পর স্বামী সম্ভু মালো ও ছেলে সুকদেব মালো ভারতে চলে যান। সেখানে স্বামী মারা যান। তিন মেয়ে নিয়ে মধ্যপাড়া গ্রামেই থেকে যান সুমিত্রা মালো। ২০১৪ সালে তিনি মারা যান।

যোগমায়াসহ ৩০-৩৫ নারীকে নেওয়া হয় মাদারীপুর এআর হাওলাদার জুট মিলে। সেখানে আটকে রেখে তাঁদের নির্যাতন করা হয়। পাঁচ দিন পর সেখান থেকে ছাড়া পান যোগমায়া।

সুমিত্রা মালোর মেয়ে বীনা রানী মালো বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বেঁচে থাকার জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছে। মা–ও অনেক কষ্ট করেছেন। দুঃখ একটাই, মা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেখে যেতে পারলেন না।’

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান বলেন, ‘যাঁদের মহান ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা, তাঁদের কষ্টের জীবন মেনে নেওয়া যায় না। চার নারী মুক্তিযোদ্ধার জন্য বীর নিবাস নির্মাণ করে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন থেকে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।’