৫০ বছরের জীবনে কত রকমের ব্যবসা করলেন পলাশ

প্রতিদিন ভোরবেলা থেকে সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত খুলনার সাউথ সেন্ট্রাল রোডের চৌরাস্তার মোড়ের ফুটপাতে বসেন পলাশ শেখ
ছবি: প্রথম আলো

খুলনা শহরের সাউথ সেন্ট্রাল রোডের চৌরাস্তার মোড়। আজ মঙ্গলবার সাতসকালে মোড়ের ফুটপাতের ওপর ছোট বাঁশের ঝুড়িতে থরে থরে পণ্য সাজিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় বসে ছিলেন পলাশ শেখ। পলাশের সেই ছোট ঝুড়িতে যেন রাজ্যের ওষধি পণ্য। ইসবগুলের ভুসি, আলকুশি, তোকমা, তালমাখনা, ত্রিফলা, সরিষা, কালিজিরা, মৌরী, মেথি, রাঁধুনি, শিমুল মূল, অর্জুনের ছাল, আমলকী, হরীতকী, বহেরা, যষ্টিমধু, বেলশুট, কথিলা, সাগুদানা, সোনাপাতা, অশ্বগন্ধা, শতমূল যেমন আছে; তেমনি আছে তেঁতুল ও জামের বীজের গুঁড়া, মুলতানি মাটি, বিট লবণ, আখের চিনির মতো পণ্য। সকালে রাস্তায় হাঁটতে বের হওয়া অনেকেই সেসব পণ্য কিনছেন।

বেচাবিক্রির ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় পলাশের সঙ্গে। পলাশের বয়স এখন ৫০ ছুঁইছুঁই। বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানার রাঘদী ইউনিয়নের ডোমরাকান্দি গ্রাম। অভাবের সংসার ছিল। নিজেদের জমি ছিল না। পড়াশোনাটাও হয়নি। তাই ছোটবেলা থেকেই কাজে নামতে হয়। দেশের বিভিন্ন শহরে প্রায় ৩৫ বছর ধরে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা করে জীবন চলছে পলাশের।

বয়স সাত-আট হওয়ার পর থেকেই অন্যের খেত-খামারে কাজ করতেন পলাশ। চার-পাঁচ বছর খেতে কাজ করার পর বছরখানেক ভ্যান চালিয়েছেন। এরপর মাথায় আসে ঢাকায় গিয়ে ব্যবসা করতে হবে। ভাবনা মতো একদিন চেপে বসেন ঢাকার লঞ্চে। সেখানে গিয়ে শ্যামবাজার থেকে অল্প পরিমাণে পেঁয়াজ, আদা, রসুন কিনে মাথায় করে ফেরি করতেন। এর কিছুদিন পর ঢাকার বাদামতলী আড়ত থেকে ফল কিনে বিক্রি করতেন আশুলিয়ার জামগড়ায়। সে সময় মাথা থেকে ফলের ঝুড়ি পড়ে গিয়ে ব্যথা পান, বিছানায় পড়তে হয় তাঁকে। ডাক্তার পরিশ্রমের কাজ কম করতে বলেন। পলাশও বেছে নেন ওষধি পণ্য বিক্রির ব্যবসা।

পলাশ বলেন, ‘ফল বেচার সময় আমার সাইডে অনেকেই এসব বেচতো। লাভও ফলের চেয়ে ভালো হয়। শুকনা মাল। পচার ভয় নেই। কোনো অসুবিধার কথা শুনলে গুছিয়ে-গুটিয়ে নিয়ে চলে যাওয়া যায়। নিরাপদ ব্যবসা। তখন মাথায় এল এটাই করতে হবে।’

পলাশ প্রথমদিকে ঢাকার মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, কল্যাণপুরে; পরে নোয়াখালী আর কুমিল্লা মিলিয়ে ১২ বছর এসব পণ্য বিক্রি করেছেন। ২০১৩ সাল থেকে তিনি খুলনায় ব্যবসা করছেন।

খুলনায় ব্যবসা করতেই ভালো লাগছে পলাশের। খুলনাকে ঝামেলাহীন শান্তির শহর মনে হয় তাঁর কাছে। কথায় কথায় পলাশ বলেন, ‘বেচাকেনা কম খুলনায়, তবে শান্তি আছে। বইস্যা থাকি, কোনো চান্দাবাজি নাই। কোনো হাউখাউ নাই। ঢাকায় যেমন ওমুক বলবে আমাকে ৫০০ দাও, তমুক বলবে আমারে ২০ টাকা দেও। এসব ধান্দাবাজি এখানে নাই। কাউরে ১০ টাকা দেওয়া লাগে না। আমি এখানে মাল রেখে ওই হোটেলে খাইতে যাই, কোনো সমস্যা নাই। আর ঢাকায় মাল রেখে কোথাও গেলে অনেক জিনিস নাই হয়ে যাইত। খুলনা শহর অনেক ভালো। ব্যবসা কইরা ভালো আছি।’

পলাশ খুলনায় থাকেন খালিশপুর নতুন রাস্তা এলাকায়। খাওয়াদাওয়া বারো মাস হোটেলে সারেন। ঢাকার মৌলভীবাজার, চকবাজার, ইমামগঞ্জ মার্কেট এবং নাটোর থেকে মালামাল কিনে আনেন। প্রতিবার লাখখানেক টাকার মালামাল কেনেন। প্রতিদিন ভোরবেলা থেকে সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত সাউথ সেন্ট্রাল রোডের চৌরাস্তার মোড়ের ফুটপাতে বসেন। এরপর থানার মোড় কেডি ঘোষ রোডে বেচাবিক্রি চলে রাত সাড়ে সাতটা-আটটা পর্যন্ত। প্রতি শুক্রবার সাতক্ষীরার তালা বাজারে যান। মাঝেমধ্যে শহরে বেচাকেনা কিছুটা মন্দা হলে চলে যান নওয়াপাড়া, কপিলমুনি আর ফুলতলা হাটে। কিনে আনা মালামাল বেচা শেষ হলে বাড়িতে কয়েকটা দিন থেকে ঢাকা গিয়ে আবার মালামাল কিনে খুলনা আসেন।

বেচাবিক্রি কেমন হয় জানতে চাইলে পলাশ শেখ বলেন, ‘ক্রেতারা সবাই পরিচিত। তাঁদের কাছ থেকে দুই টাকা চেয়ে নিই, তবে খারাপ জিনিস কখনো বেচি না। ফাল্গুন থেকে জৈষ্ঠ্যের শেষ পর্যন্ত প্রচুর কেনাবেচা হয়। শীতে কিছুটা কম। প্রতিদিন গড়ে চার থেকে আট হাজার টাকা বিক্রি হয়। মাসে ৩০ হাজারের মতো লাভ হয়। আর থাকা খাওয়া অন্যসব বাদ দিয়ে হাতে থাকে ২০ হাজারের মতো। তবে শবে বরাতের পর থেকে ঈদের আগপর্যন্ত বেচাকেনা অনেক বেশি। রোজার মাসে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার বেচাকেনা হয়েছে। বললে তো আর নিয়ে যাবেন না। শবে বরাত থেকে ঈদের আগপর্যন্ত কম করে ৮০ হাজার টাকার মতো লাভই হয়েছে।’

জীবনে তিন-চার দিন স্কুলে গেছেন পলাশ। পড়ালেখা না জানায় হিসাব করতে অসুবিধা হয় কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পড়ালেখা না জানলে সমস্যা তো হয়ই। তবে অভ্যাস হয়ে গেছে। একটা অনুমান আছে। এই টাকায় এতগুলো মাল হবে। যদি অনুমানে না খাটে তখন ধরেন স্লিপ নিয়ে অন্যজনের কাছে যাইতে হয়। কোনটা কত দাম রাখছে, শুনে নিই। বেশি রাখলে দোকানদারকে ফোন দিই। এভাবেই চলে যাচ্ছে।’

কথায় কথায় পলাশ জানান, চরম অভাবের দিন তাঁদের আর নেই। আগে একটা গোলপাতার ঘরে তিন ভাই আর মা-বাবা সবাই মিলে বাস করেছেন। এখন আয় থেকে প্রায় ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে ঘর করেছেন। ছেলেটাও রোজগার করছে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘এখন অভাব নেই। তবে ধরা খাইছি। কিছুদিন আগে ছেলেকে একটা ফার্নিচারের দোকান করে দেওয়ার জন্য ঢাকার আইজিগেট এলাকায় এক দোকানে আট লাখ টাকা অগ্রিম দিয়েছিলাম। কাগজপত্রও দিয়েছিল। পরে দেখি তাঁরা মূল মালিক ছিল না, ওই দোকানের ভাড়াটিয়া ছিল। আমার টাকা মার খেয়ে যায়। আত্মীয়দের অনেকেই বিদেশ থাকেন। নিয়ত আছে ছেলেকে বাইরে পাঠাব।’

যত দিন সম্ভব খুলনাতেই থাকতে চেয়ে পলাশ বলেন, ‘এই ব্যবসায় পরিশ্রম তো তেমন নেই। যত দিন শরীর কুলাবে এই ব্যবসা করব। আর খুলনাতেই থাকব।’