৭ জেলায় প্রায় ২ লাখ লিটার তেল জব্দ

কুষ্টিয়ায় এক ব্যবসায়ীর গুদামে মজুত করা ৪০ হাজার লিটার তেল তিন দিনের মধ্যে খোলাবাজারে বিক্রির নির্দেশ।

গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকায় দুটি তেলের গুদামে অভিযান চালিয়ে ৭ হাজার ১৫৮ লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সদস্যরা। গতকাল দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

সরকার ভোজ্যতেলের দর ঠিক করে দেওয়ার পাঁচ দিনেও বাজারে সংকট কাটেনি। গতকাল মঙ্গলবারও দেশের অনেক স্থানে ক্রেতারা বাজারে ও অলিগলির দোকানে নির্ধারিত মূল্যে সয়াবিন তেল পাননি। কিন্তু জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও পুলিশের অভিযানে গুদাম থেকে বেরিয়ে আসছে ব্যবসায়ীদের মজুত করা হাজার হাজার লিটার তেল।

গত দুই দিনে সাত জেলায় অভিযান চালিয়ে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৬ লিটার ভোজ্যতেল জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া কুষ্টিয়ায় এক ব্যবসায়ীর গুদামে মজুত করা ৪০ হাজার লিটার সয়াবিন তেল পাওয়া গেছে। ওই ব্যবসায়ীকে জরিমানার পর তিন দিনের মধ্যে ওই তেল খোলাবাজারে বিক্রির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অবৈধভাবে তেল মজুতের দায়ে গতকাল আট জেলার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

তেলের সঙ্গে গছানো হচ্ছে পণ্য

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাজারের নতুন নির্ধারিত দামের বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে। তবে এখনো পরিবেশকেরা সয়াবিন তেলের সঙ্গে দোকানিদের কাছে চা–পাতা, শর্ষের তেল, চিনি, হালিম ও ফিরনির মতো বিভিন্ন পণ্য বাধ্যতামূলক গছিয়ে দিচ্ছেন। খুচরা বিক্রেতারাও তাই সয়াবিন তেলের সঙ্গে অন্য পণ্য কিনতে ক্রেতাদের বাধ্য করছেন।

গতকাল রাজধানীতে শুধু তীর ও ফ্রেশ কোম্পানির সয়াবিন তেল বিক্রি করতে দেখা গেছে। রূপচাঁদা ও বসুন্ধরা কোম্পানির নতুন দামের তেল বাজারে আসেনি বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।

রাজধানীর মিরপুর এলাকার ভাষানটেক, মিরপুর ৬ নম্বর সেকশন, গুলশান এলাকার বারিধারা নতুন বাজার এবং বাড্ডা এলাকার উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজারের বেশির ভাগ দোকানে সয়াবিন তেল বিক্রি করতে দেখা গেছে। কিন্তু ওই এলাকার পাড়া-মহল্লার দোকানে সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি।

চার বাজারের একটি দোকানে খোলা সয়াবিন তেল ও অন্যটিতে পাম সুপার তেল বিক্রি করতে দেখা গেছে। তবে সরকার–নির্ধারিত দরের চেয়ে খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ২০ টাকা বেশি ও পাম সুপার লিটারে ৮ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হয়। বেলা একটার দিকে ভাষানটেক বাজারে গিয়ে দুটি দোকানে এক কোম্পানির ২ লিটার ও ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি করতে দেখা গেছে। তবে সয়াবিন তেলের সঙ্গে পরিবেশক এক বস্তা করে লবণ দিয়ে গেছেন বলে জানান ওই দুটি দোকানের মালিকেরা।

বিকেলে উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজারে গিয়ে ভাই ভাই জেনারেল স্টোর নামের একটি দোকানে এক কোম্পানির সয়াবিন তেলের ২ লিটার বোতল বিক্রি করতে দেখা গেছে। তবে এক বোতল তেলের সঙ্গে ২৫০ গ্রাম ওজনের এক বোতল শর্ষে তেল কিনতে হবে বলে জানান বিক্রেতা তুহিন মিয়া।

বারিধারা নতুন বাজারের যেসব দোকানে অপর এক কোম্পানির সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছিল, ওই দোকানিরাও তেলের সঙ্গে পরিবেশকের কাছ থেকে অন্য পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে বলে জানান।

বারিধারা এলাকার একটি কোম্পানির তেলের ডিলার অজয় সাহা গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কোম্পানি থেকে তাঁদের শর্ষে তেল, হালিম ও ফিরনি দেওয়া হয়েছিল। ওগুলোই এখন একটু একটু করে দোকানিদের কাছে দেওয়া হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ৫ মে সরকার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৮০ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে।

আট স্থানে অভিযান, জরিমানা

মজুত করা তেল উদ্ধারে সবচেয়ে বড় অভিযানটি চালানো হয় রাজশাহীর বানেশ্বরে। গতকাল বিকেলে পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর বাজারের চারটি গুদাম ও একটি ট্রাক থেকে ৯২ হাজার ৬১৬ লিটার ভোজ্যতেল জব্দ করা হয়। এর মধ্যে ২৪ হাজার ৬৮৪ লিটার সয়াবিন ও ৬৭ হাজার ৯৩২ লিটার পাম তেল রয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছে, বানেশ্বরে বাজারের সরকার অ্যান্ড সন্স, ইন্তাজ স্টোর, মেসার্স পাল অ্যান্ড ব্রাদার্স ও রিয়া স্টোর থেকে তেল জব্দ করা হয়। সরকার অ্যান্ড সন্সের মালিক বিকাশ কৃষ্ণ সরকার দাবি করেন, তাঁরা কখনো তেল মজুতের ব্যবসা করেন না। তাঁর সয়াবিন সরকারিভাবে দাম বাড়ানোর পরে কে না। আর পাম তেল ঈদের এক দিন আগে তাঁর গুদামে এসেছে। রাজশাহীর পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, দ্রুত আদালতের অনুমতি নিয়ে জব্দ করা তেল টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করা হবে। গতকাল রাতে জেলার গোদাগাড়ীতে অভিযান চালিয়ে ২০ হাজার ৪০০ লিটার ভোজ্যতেল জব্দ করা হয়।

গত সোমবার রাতে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় এক ব্যবসায়ীর গুদামে অভিযান চালিয়ে আরও ৬ হাজার লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করে পুলিশ। এর আগে সোমবার অপর এক ব্যবসায়ীর গুদামে অভিযান চালিয়ে ২০ হাজার লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করা হয়।

আরেকটি বড় অভিযান চালানো হয় কুষ্টিয়ায়। গতকাল সকালে শহরের বড়বাজার এলাকায় মেসার্স মা ফুড প্রোডাক্টসের গুদামে পাওয়া গেছে ৪০ হাজার লিটার সয়াবিন তেল। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কুষ্টিয়া জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে তেল মজুতের দায়ে গুদামমালিককে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। অধিদপ্তরের কুষ্টিয়া জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সুচন্দন মণ্ডল বলেন, তিন দিনের মধ্যে এসব তেল খোলাবাজারে বিক্রি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিন দিন পর আবার গুদামে খোঁজ নেওয়া হবে।

গতকাল পাবনার ঈশ্বরদীতে শ্যামল স্টোর নামে একটি মুদিদোকানের গুদামে অভিযান চালিয়ে ১৮ হাজার ২৪৪ লিটার ভোজ্যতেল উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় ওই দোকানের মালিক শ্যামল দত্তকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

তেল মজুত, নির্ধারিত মূল্যের বেশি দামে তেল বিক্রি ও তেলের সঙ্গে অন্য পণ্য কিনতে বাধ্য করার দায়ে ১৭ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার তিনটি প্রতিষ্ঠানকে। ওই তিন প্রতিষ্ঠান থেকে ৬ হাজার লিটার ভোজ্যতেল জব্দ করা হয়।

৭ হাজার লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করা হয়েছে গাজীপুর থেকে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, গাজীপুরের কর্মকর্তারা দুটি গুদামে অভিযান চালিয়ে ওই তেল জব্দ করেন। পরে এসব তেল সরকার–নির্ধারিত দামে স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করা হয়। আর ওই দুই গুদাম মালিককে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

সিলেটের কালীঘাট এলাকার মাহের ব্রাদার্স নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মজুত করা ৫ হাজার লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করা হয়। পরে সেই তেল নির্ধারিত মূল্যে সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে বিক্রি করা হয়।

পটুয়াখালীর দুমকিতে মুরাদিয়া বোর্ড অফিস বাজারে তিন ব্যবসায়ীর গুদাম থেকে ৩ হাজার ১০৬ লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করা হয়েছে। তেল মজুত রাখার দায়ে এক ব্যবসায়ীকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

বরিশাল নগরের সাগরদী বাজার ও বাবুগঞ্জের রহমতপুর বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল বাড়তি দামে বিক্রির দায়ে দুটি প্রতিষ্ঠানকে ১৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে মূল্যতালিকা প্রদর্শন না করায় আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানকে তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ সময় রহমতপুর বাজারের একটি পাইকারি দোকান থেকে ৭০০ লিটার মজুত করা সয়াবিন তেলও উদ্ধার করা হয়।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা, রাজশাহী, বরিশাল, কুষ্টিয়া; প্রতিনিধি, পাবনা, পটুয়াখালী, সিলেট, বাগমারা (রাজশাহী)]