৯১ কিমি বাঁধের ক্ষতি, কয়েক শ গ্রাম প্লাবিত

জোয়ারে কপোতাক্ষ নদের বাঁধ ভেঙে প্লাবিত গাবুরা ইউনিয়ন। ভেসে গেছে বসতঘরসহ মাছের ঘের। পানির গভীরতা বোঝার চেষ্টা করছেন স্থানীয় এক বাসিন্দা। গতকাল বেলা দুইটায় সাতক্ষীরার শ্যামনগরে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

কেটে গেছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব। ফুটে উঠছে উপকূলভাগে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। অধিক উচ্চতার জোয়ারের পানি বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে ঢুকে তলিয়ে গেছে কয়েক শ গ্রাম। ভেসে গেছে মাছ ও চিংড়ির ঘের। তিন দিন ধরে উপকূলীয় এলাকার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ মেরামতের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন।

ইয়াসের প্রভাবে মূলত দক্ষিণ উপকূল ও উপকূল-সংলগ্ন ৯টি জেলা বরিশাল, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠি, বরগুনা, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং চট্টগ্রামের কক্সবাজার ও নোয়াখালীতে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। এর মধ্যে চার জেলায় ৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। আর সাত জেলায় প্রায় ৯১ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে প্রায় ৬৮২টি গ্রাম ও ৫০টি চরাঞ্চল। উপরোক্ত ১১ জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), মৎস্য বিভাগ, কৃষি কার্যালয়, জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় এবং জেলা প্রশাসন সূত্রে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

জোয়ারের পানিতে ভেসে গিয়ে ও গাছের ডাল পড়ে গত বুধবার আটজন মারা যান। আর গতকাল মারা যান তিনজন। তাঁদের দুজনের বাড়ি পটুয়াখালীর দুমকি ও কলাপাড়ায়। দুমকিতে মারা যাওয়া হাছিনা বেগম (৫৫) নদীতীরে হোগলা পাতা কাটতে গিয়ে জোয়ারের পানিতে ভেসে যান। আর কলাপাড়ায় সাত বছরের এক শিশু জোয়ারের পানিতে ডুবে মারা গেছে। মৃত অপরজন কক্সবাজার মহেশখালীর এক কিশোর। সোনাদিয়া দ্বীপে যাওয়ার পথে মোহাম্মদ হোসেন নামের ওই কিশোর পানিতে ভেসে যায়।

বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ, হিজলা, মুলাদী, উজিরপুর ও সদরের অন্তত ১২০টি গ্রামে গতকাল জোয়ারের পানি ছিল। এ জেলায় ইয়াসের প্রভাবে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৬২টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে গেছে শূন্য দশমিক ২২০ কিলোমিটার বাঁধ। আর ৩ দশমিক ৬৬৯ কিলোমিটার বাঁধের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে ১ হাজার ৭২৮টি ঘের ও পুকুরের মাছ।

বাঁধের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বরিশাল পাউবো আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরদার প্রথম আলোকে বলেন, এটা প্রাথমিক হিসাব। পূর্ণাঙ্গ হিসাব পেতে আরও কয়েক দিন লাগবে। মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তারা কাজ করছেন।

পিরোজপুরে ৩৭টি ইউনিয়নের ১০০টি গ্রামে এখনো জোয়ারের পানি রয়ে গেছে। জেলার ১৬৭ হেক্টরে আউশ, ৭ হাজার ৩১৮ হেক্টরে আউশ বীজতলা পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। জোয়ারের পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে ২ হাজার ১৫৭টি পুকুর ও ঘের। ভেঙে গেছে ৭৮০ মিটার বাঁধ, আর ক্ষতি হয়েছে ৬ কিলোমিটার বাঁধের।

পটুয়াখালীতে ২২৩টি গ্রাম জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। তিন কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে গেছে, আর ৪১ কিলোমিটার বাঁধের ক্ষতি হয়েছে। ঝালকাঠির পাঁচ ইউনিয়নের ১০টি গ্রামে জোয়ারের পানি গতকাল পর্যন্ত ছিল। প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, জেলার ৩ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে ২ হাজার ১৩৯টি পুকুর ও খামারের মাছ।

ঝালকাঠি পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন বলেন, ইয়াসের প্রভাবে জেলার বেড়িবাঁধগুলোর ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়ামাত্র কাজ শুরু করা হবে।

অধিক উচ্চতার জোয়ারে বরগুনা জেলায় ১ হাজার ২৪৯টি মাছের ঘের ও পুকুর তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে ৬০ মেট্রিক টন মাছ। ১ হাজার ২৬৩ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।

বরগুনার বলেশ্বর নদতীরের পশ্চিম কাঁঠালতলী এলাকার বাসিন্দা লাইলী বেগম ও আয়শা আক্তার জানান, তিন দিন আগে সর্বশেষ রান্না করেছিলেন। ছেলেমেয়েদের মুখে সামান্য কিছু শুকনা খাবার ছাড়া গত তিন দিনে কিছু দিতে পারেননি।

গতকাল দুপুরের জোয়ারে বাগেরহাটের ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জেলায় বিভিন্ন ফসলের ১৬৫ হেক্টর জমি ও প্রায় ৩ হাজার মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূল বেড়িবাঁধের ক্ষতি না হলেও জেলার পাঁচ উপজেলায় প্রায় তিন কিলোমিটার গ্রামীণ বাঁধের ক্ষতি হয়েছে।

ভোলায় ৩৩টি ইউনিয়নের ৫০টি চরাঞ্চল, বাঁধের বাইরের লক্ষাধিক মানুষ প্লাবিত হয়েছে। জোয়ারে পানিতে গতকালও অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

জেলার চরফ্যাশন উপজেলার কুকরি-মুকরি ইউনিয়নের চরপাতিলা মৌজার বাসিন্দা হারুন অর রশিদের ঘরটি পানিতে ডুবে গেছে। আশপাশে কোনো শুকনো জায়গা নেই। হারুন অর রশিদ বলেন, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে তাঁর ৫০ হাজার টাকার জাল, পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। লোনাপানিতে পুকুরের মাছ মরে গেছে। লোনাপানিতে নষ্ট হয়েছে শসাখেত। রান্নাঘরের চুলা ডুবে গেছে। শুকনা খাবার খেয়ে কোনো রকমে দিন কাটছে।

খুলনার চার উপজেলার ৩৭টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সময় সাড়ে ৬ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষকে পুনর্বাসন করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া পর্যাপ্ত শুকনা খাবার ও বাঁধ সংস্কারের জন্য টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

সাতক্ষীরার ১২টি ইউনিয়নের ২১টি গ্রাম জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়। এ সময় ৩৫ হাজার পরিবারের দুই লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। জেলায় ৩ হাজার ৬০০ হেক্টর চিংড়ি ও মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২১টি স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে। আর ২০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কক্সবাজারে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে ১২১টি গ্রাম। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ৫৭০টি ঘরবাড়ি। এসব বাড়ির ৩ হাজারের বেশি মানুষ গতকাল পর্যন্ত ঘরে ফিরতে পারেনি। বৃষ্টিতে ২ হাজার ১০০ টন লবণ ভেসে গেছে। ১২০টির বেশি ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে বিপুল পরিমাণ শুঁটকি মাছ। এদিকে কুতুবদিয়া ও মহেশখালীতে ১১টি অংশে ১৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ক্ষতি হয়েছে।

এদিকে নোয়াখালীতে ১১টি পয়েন্টে প্রায় ১০০ মিটার বাঁধ ভেঙে গেছে। তিনটি ইউনিয়নে কিছু বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদকপ্রতিনিধিরা]