জিম্মি উদ্ধারে গিয়ে হামলায় পুলিশ আহত, গ্রেপ্তার ৬

শ্রীপুরের একটি গ্রামে দুই দিন ধরে জিম্মি করে মুক্তিপণ চাইছে—৯৯৯-এ এমন ফোন পেয়ে জিম্মি উদ্ধারে যান গাজীপুরের শ্রীপুর থানার তিন পুলিশ সদস্য। সেখানে গিয়ে হামলার শিকার হন তাঁরা। তাঁদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয় শটগান ও গুলিভর্তি ম্যাগাজিন। পরে অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে ছয়জনকে আটক করে।

বিদেশে পাঠাবেন বলে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের মো. ইসমাইল ও ইসমাইলের আরেক আত্মীয় রফিকুল ইসলাম মণ্ডলের কাছ দেড় লাখ টাকা নিয়েছিলেন আবুল হোসেন। তিনি বিদেশে লোক পাঠানোর একটি রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত। ওই প্রতিষ্ঠানকে আরও টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে বিদেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া পিছিয়ে যায়।

প্রতিশ্রুত সময়সীমা বেড়ে যাওয়ায় গ্রাহকেরা আর ধৈর্য ধরতে পারছিলেন না। আবুল হোসেন করোনাকালটা অপেক্ষা করতে বললে তাঁরা ধৈর্যচ্যুত হন। তাঁরা টাকা ফেরত চান আবুল হোসেনের কাছে। তিনি এখন পুরো টাকা দিতে পারবেন না বলে সময় চান। তবু ওই দুই গ্রাহকের পীড়াপীড়িতে ৫০ হাজার টাকা ফেরতও দেন। কিন্তু এরই মধ্যে গ্রাহকেরা আঁটেন অন্য পরিকল্পনা।

বিদেশ গমনেচ্ছু ওই দুজন কৌশলে আরও কয়েকজনকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে আবুল হোসেনকে শ্রীপুরে বাড়িতে ডেকে নেন। সেখানে যেতেই তাঁরা তাঁকে আটক করেন। এ সময় তাঁর কাছে ৫ লাখ টাকা পাওনা আছে মর্মে স্ট্যাম্পে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেন ইসমাইল ও তাঁর সঙ্গীরা। টাকা না দিলে তাঁকে ছাড়া হবে না বলেন। এভাবে জিম্মিদশায় দুই দিন কেটে যায় আবুল হোসেনের। পরে তিনি টাকা আনার কথা বলে তাঁর বন্ধু ফয়সালকে ফোন করে পুরো ঘটনা জানান। বিষয়টি জানার ফয়সাল ও তাঁর আরেক বন্ধু আবুল কালাম আটক আবুল হোসেনকে মুক্ত করতে শ্রীপুরের ওই বাসায় যান। এ সময় তাঁদের দুজনকেও আটক করেন ইসমাইল, রফিকুল ও তাঁদের লোকজন। এক ফাঁকে ফয়সাল কৌশলে তিনজনের জিম্মি হওয়ার ঘটনাটি জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ কল দিয়ে জানান।

জিম্মিদের উদ্ধারে ঘটনাস্থলে যায় শ্রীপুর থানার পুলিশ। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর পুলিশের ওপর লাঠিসোঁটা ও রড নিয়ে হামলা চালান ইসমাইল, রফিকুল ও তাঁর সহযোগীরা। পুলিশের কাছ থেকে তাঁরা কেড়ে নেন শটগান ও গুলিভর্তি ম্যাগাজিন। পরে পুলিশের আরও সদস্য গিয়ে আহত পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। উদ্ধার হয় কেড়ে নেওয়া অস্ত্র ও গুলি। আটক করা হয় জিম্মি ও হামলার সঙ্গে জড়িত ছয়জনকে। ঘটনার মূল হোতা মো. ইসমাইল ও রফিকুল ইসলাম মণ্ডলকে ধরার আগেই তাঁরা পালিয়ে গেছেন। গাজীপুরের শ্রীপুরের রাজাবাড়ি ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামে গতকাল শুক্রবার রাতে এ ঘটনা ঘটে।

জিম্মিদের উদ্ধারে গিয়ে আহত শ্রীপুর থানার উপপরিদর্শক রফিকুল ইসলাম
প্রথম আলো

এসব তথ্য নিশ্চিত করে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার ইমাম হোসেন জানান, এ ঘটনায় আহত পুলিশ সদস্যরা হলেন শ্রীপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রফিকুল ইসলাম, কনস্টেবল খোরশেদ আলম ও মিজানুর রহমান। তাঁরা আহত হয়ে শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছেন। পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ২৪ জনকে আসামি করে শ্রীপুর থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। আটক ছয়জনকে আগামীকাল রোববার আদালতে তোলার কথা রয়েছে।

আটক ছয়জন হলেন শ্রীপুরের নোয়াগাঁও গ্রামের নাজমুল হোসেন রকির স্ত্রী মনীষা মনি (২৫), একই গ্রামের মো. আজাহার (৫৫), নয়নপুর দীঘলাপাড়া গ্রামের ফরহাদ (১৮), শেরপুর জেলা সদরের কালিগঞ্জ দমদমা গ্রামের মোসাম্মত রুশনী (৪০), নড়াইল জেলার লোহাগাড়া উপজেলার লাহুড়া গ্রামের তাজুল ইসলাম (২৪) ও ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার হাজারীগঞ্জ গ্রামের আবদুর রহমান (২০)।

জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার মঙ্গলকান্দি গ্রামের ফয়সাল আহমেদ (৩৬), একই জেলার দেবীদ্বার উপজেলার নাবিয়াবাধা গ্রামের আবুল হোসেন (৪৫) ও দেবীদ্বার উপজেলার জাফরাবাদ গ্রামের আবুল কালাম (৩২)।

শ্রীপুর থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলা সূত্রে জানা যায়, এসআই রফিকুল গতকাল রাতে দায়িত্ব পালনকালে ৯৯৯ থেকে ফোন পান। ফোন করে বলা হয়, শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ী ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামে রফিকুল ইসলাম বাড়িতে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে কয়েকজনকে দুই দিন ধরে জিম্মি করে রাখা হয়েছে এবং তাঁদের কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে। খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে দুই কনস্টেবলকে নিয়ে যান তিনি। এ সময় হঠাৎ লাঠিসোঁটা ও রড নিয়ে পুলিশ ও উদ্ধার ব্যক্তিদের ওপর হামলা করেন রফিকুল ইসলাম মণ্ডল ও তাঁর লোকজন। এ সময় এসআই রফিকুলের মাথায়, কপালে ও পিঠে রড দিয়ে আঘাত করা হয়। মারপিট করা হয় তাঁর সঙ্গে থাকা অপর দুই পুলিশ সদস্যকেও। এ সময় এসআই রফিকুলের সঙ্গে থাকা ১০ রাউন্ড গুলিভর্তি ম্যাগাজিন, কনস্টেবল খোরশেদ আলমের সঙ্গে থাকা ১টি শটগান ও ৪ রাউন্ড শটগানের গুলি ছিনিয়ে নেন হামলাকারীরা। পরে থানায় খবর দিলে আরও পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তাঁদের সেখান থেকে উদ্ধার করেন। এ সময় সেখানে শ্রীপুর থানা-পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়।

জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার আবুল হোসেন বলেন, এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদেশে পাঠানোর জন্য ভিসা প্রসেসিং ও অন্যান্য খরচবাবদ নোয়াগাঁও গ্রামের মো. ইসমাইল ও ইসমাইলের আরেক আত্মীয়ের কাছ থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা নেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে তাঁদের বিদেশে পাঠানো সম্ভব হয়নি। এ জন্য ইসমাইল তাঁর টাকা ফেরত চান। ৫০ হাজার টাকা তিনি ইসমাইলকে ফেরত পাঠিয়ে দেন। সম্প্রতি ইসমাইল আরও কয়েকজনকে বিদেশ পাঠানোর বিষয়ে আবুল হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে তাঁকে শ্রীপুরে আসতে বলেন। আবুল হোসেন ২৪ সেপ্টেম্বর ইসমাইলের বাসায় যান। পরে তাঁকে ইসমাইল ও তাঁর সঙ্গীরা আটক করেন। এ সময় ৫ লাখ টাকা পাওনা আছে মর্মে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে জোরপূর্বক স্বাক্ষর রাখেন। পরে তাঁর বন্ধু ফয়সাল ও আবুল কালাম তাঁকে উদ্ধারে গেলে তাঁদেরও আটক করেন ইসমাইল ও তাঁর সঙ্গীরা। এক ফাঁকে ফয়সাল ৯৯৯-এ কল দিয়ে বিষয়টি জানান। শ্রীপুর থানা-পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁদের উদ্ধারে এলে তাদের ওপরও হামলা করেন জিম্মিকারীরা। এ সময় অতিরিক্ত পুলিশ এসে তাঁদের সবাইকে উদ্ধার করে।

শ্রীপুর থানার ওসি খন্দকার ইমাম হোসেন আজ প্রথম আলোকে বলেন, ছয় আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। বাকি ১৮ আসামিকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশি তৎপরতা চলমান আছে। আহত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।