প্রকৃতিতে উচ্ছ্বাস, মানুষ ফাঁপরে

হাওর-নদীময় সিলেটের গোয়াইনঘাটের যাতায়াত ব্যবস্থা ‘বর্ষায় নাও-হেমন্তে পাও’ প্রবাদবাক্যের মতো। ‘নাওবাজার জমছে তো মানুষ সুখশান্তিতে আছে’ স্থানীয়দের অনেকেরই এমন বিশ্বাস চলে আসছে বহু বছর ধরে। পানি বাড়লে নৌকার কদরও বাড়ে। কিন্তু চলতি বর্ষায় পানি বাড়লেও নৌকা বিক্রির সংখ্যা কম। করোনাই এই মন্দার কারণ। বিক্রি নেই বলে উদাস বসে এক নৌকা বিক্রেতা। সম্প্রতি শালুটিকর নাওবাজারে। ছবি: আনিস মাহমুদ
হাওর-নদীময় সিলেটের গোয়াইনঘাটের যাতায়াত ব্যবস্থা ‘বর্ষায় নাও-হেমন্তে পাও’ প্রবাদবাক্যের মতো। ‘নাওবাজার জমছে তো মানুষ সুখশান্তিতে আছে’ স্থানীয়দের অনেকেরই এমন বিশ্বাস চলে আসছে বহু বছর ধরে। পানি বাড়লে নৌকার কদরও বাড়ে। কিন্তু চলতি বর্ষায় পানি বাড়লেও নৌকা বিক্রির সংখ্যা কম। করোনাই এই মন্দার কারণ। বিক্রি নেই বলে উদাস বসে এক নৌকা বিক্রেতা। সম্প্রতি শালুটিকর নাওবাজারে। ছবি: আনিস মাহমুদ
সিলেটের ১৩টি উপজেলার মধ্যে ৪৮৮ দশমিক ৭০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে সীমান্তঘেঁষা উপজেলা গোয়াইনঘাট। এর ইউনিয়ন ৯টি ও গ্রাম ২৬৬টি। প্রায় সাড়ে তিন লাখ লোকসংখ্যার এ উপজেলায় মানুষের প্রধান জীবিকা হাওর-বিলে ধান চাষ, মাছ আহরণ ও পাথর কোয়ারিকেন্দ্রিক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর গোয়াইনঘাট। জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুল, পান্থুমাইয়ের মতো দেশের শীর্ষ পর্যটনকেন্দ্রের অবস্থান এই উপজেলাতেই। করোনাকালে এই জনপদজুড়ে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী আর প্রান্তিক মানুষের কষ্টের গল্পগুলো ভিন্ন রকম হলেও জীবনযাপনে একটি বিষয় অভিন্ন। আর তা হলো, অত্যন্ত মানবেতর আর দুর্বিষহ অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় কাটছে তাঁদের। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে উঠে এসেছে তাঁদের কষ্টের চিত্র।

জলাবন রাতারগুল বেড়াতে গেলে পথে পড়ে মটরঘাট। আগে সেখানে সারি সারি নৌকা বাঁধা থাকত। ঘাটে পা পড়ামাত্র ঘিরে ধরতেন নৌকার মাঝিরা। তাঁরা একেকজন যেন জল ও বনের সবজান্তা ভ্রমণসঙ্গী। অতিথিকে সমাদরে ঘাট থেকে আগলে নিয়ে যেতেন। নৌকায় ওঠার আগে জানতে চাইতেন সাঁতার শেখা আছে কি না। উত্তর হ্যাঁ হলে যেতেন গহিন জল দিয়ে। আর সাঁতার না জানলে সতর্কতায় তীর ঘেঁষে ধীরলয়ে চলত তাঁদের তরি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে জলাবন দেখা হয়ে যেত। বেড়ানো শেষে নিরাপদে ঘাটে ফিরে নৌকার ভাড়া মিটিয়ে দিতেই ‘আরওকবার আইবা, কল দিবা...’ বলে এক টুকরা কাগজ ধরিয়ে দিতেন মাঝি। তাতে ভাঙা ভাঙা হাতের লেখার অক্ষরে তাঁদের মুঠোফোন নম্বরটি থাকত।

গেলবার বর্ষার এমন সময়ে মটরঘাট থেকে শ শ নৌকা চলতে দেখা গেছে। এক নৌকায় দুই থেকে তিনজন থাকতেন এই মাঝি কাম ট্যুরিস্ট গাইডরা। করোনাকালের এই ভরা বর্ষায় সেখানে এখন কোনো নৌকা নেই। মাঝিরা সব গেলেন কই, মানুষগুলো কী করছেন এখন—এসব জানতে চাইলে রাতারগুল গ্রামের সোনা মিয়া মুখে শুকনো হাসি হেসে বলেন, ‘এইটা তাঁরার বাড়তি রুজির পথ আছিল। মানুষের বেড়ানোর সুখে অসুখ লাগছে। রুজির পথও বন্ধ। কেউ আর ইখানও নাই। না জানি কয় দিন চলব ই অবস্থা।’

এই ‘বেড়ানোর সুখ’ শুধু রাতারগুল নয়, সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পুরোটা জুড়েই লেগে ছিল এই কিছুদিন আগেও। জল, বন, হাওর, নদী, পাহাড় আর পাথর—প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক আধার। সীমান্তঘেঁষা এই জনপদ ঘিরে সিলেট জেলা প্রশাসনের পর্যটন ব্র্যান্ডিং হয়েছে। ‘প্রকৃতিকন্যা’ নামে দেশে ও বিদেশে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছনাকান্দি, পান্তুমাই মায়াবী ঝরনা আর জলাবন রাতারগুল।

জলাবন রাতারগুল। বর্ষার এমন সময় হাজারো পর্যটকের ভিড় থাকত। করোনাকালে কেউ নেই। এই সুযোগে অবশ্য জলাবনের গাছ আরও ঘন হয়েছে। ৬ জুলাই রাতারগুল গ্রাম থেকে তোলা ছবি। ছবি: আনিস মাহমুদ
জলাবন রাতারগুল। বর্ষার এমন সময় হাজারো পর্যটকের ভিড় থাকত। করোনাকালে কেউ নেই। এই সুযোগে অবশ্য জলাবনের গাছ আরও ঘন হয়েছে। ৬ জুলাই রাতারগুল গ্রাম থেকে তোলা ছবি। ছবি: আনিস মাহমুদ

৬ জুলাই বৃষ্টিভেজা বিকেলে মটরঘাট হয়ে রাতারগুল দেখা। গোয়াইনঘাটের ফতেপুর ইউনিয়নের মধ্যভাগে পড়েছে বনের এই পথটি। ১৯৭৩ সালে বন বিভাগ জলারবন হিসেবে সংরক্ষিত ঘোষণা করে রাতারগুলকে। নদী ও হাওরবেষ্টিত ৫০৪ দশমিক ৫০ একর আয়তনের বন-এলাকা প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অনেকটা অজানা ছিল। ২০১২ সালের বিশ্ব পর্যটন দিবসে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় রাতারগুলের একটি আলোকচিত্র নতুন করে পরিচিত করে তোলে এই জলাবনকে। সেই থেকে বর্ষাকালে বেড়ানোর জন্য সিলেট অঞ্চলের আকর্ষণীয় একটি স্থানে পরিণত হয় রাতারগুল। পর্যটকদের বেড়ানোর সুখে সাত বছর পর ছেদ পড়ল করোনায়। করোনাভাইরাস সংক্রমণের একেবারে চূড়ান্ত মুহূর্তে সিলেট লকডাউন ঘোষণার আগে থেকেই এখানে সীমিত হয়ে পড়েছিল পর্যটকদের যাতায়াত। যাও ছিল, তাতে ছিল নজরদারি। ২৫ মার্চ থেকে এখানে যাতায়াত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে প্রশাসন। এরপর থেকে মানুষশূন্য একটানা প্রায় তিন মাস। এই বর্ষায় রাতারগুল তার নামের মতোই শুধু জল আর বনের মিতালি। অথচ দেখার উচাটন নিয়ে মানুষের ঘুরে বেড়ানো নেই।

বনের গায়ে সুদিন
রাতারগুলে মানুষের পদচারণ নেই একটানা প্রায় তিন মাস। তাই জল আর বনের গায়ে যেন সুদিন লেগেছে। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা হিজল, করচ, বরুণগাছের পাশাপাশি বেত, ইকরা, খাগড়া, মুর্তা ও শণজাতীয় গাছের বাড়বাড়ন্ত রূপ দেখা যাচ্ছে। আরও গাঢ় হয়েছে বন।

সিলেট বন বিভাগের সারী রেঞ্জের অধীন এই জলাবন। সারী রেঞ্জ কর্মকর্তা সাদ উদ্দিন জানান, সংরক্ষিত বনে ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদের সঙ্গে ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৭৫ প্রজাতির পাখি ও ৯ প্রজাতির উভচর প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে বলে একটি হিসাব তাঁদের রয়েছে। পুরোনো হিসাবটা এবার হালনাগাদ হবে। বন জনমানবহীন থাকায় প্রাকৃতিক সব সম্পদই বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন তাঁরা।

শুধু রাতারগুলই নয়, বিছনাকান্দি, পান্তুমাই ঝরনা, জাফলংয়ের মতো আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্রগুলোও মানুষের পদচারণশূন্যতায় সুনসান করছে। এ অবস্থায় পর্যটনকেন্দ্রের রূপপ্রকৃতি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেকগুণ বেড়েছে। ‘মায়াবী ঝরনা’ নামের পান্তুমাই এলাকা পাহাড়ি। সীমানা ছাড়িয়ে অবস্থান। ঘুরতে আসা মানুষজনকে সতর্কতার সঙ্গে শুধু এপারে থেকে ঝরনার জলে অবগাহন করতে হয়। এখন ভরা বর্ষা। ওপারে বৃষ্টি হলেই বেড়ে যায় ঝরনার জলধ্বনি।

বিছনাকান্দি-জাফলং-পান্তুমাই ঝরনা দেখতে বর্ষাকালে গোয়াইনঘাটে প্রতিদিন ৫০ হাজার মানুষের যাতায়াত ছিল। ছুটির দিনে মানুষের ঢল নামত। জাফলং বাজার ও বিছনাকান্দির পাশের হাদারপাড় বাজারের বাণিজ্যিক তৎপরতাও ছিল পর্যটকনির্ভর। রেস্তোরাঁ আর প্রসাধনসামগ্রীর দোকানগুলোতে ব্যবসা বেশি হতো। করোনাকালে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এই দুই খাতের খুদে ব্যবসায়ীরা। প্রসাধন ব্যবসায়ী আবদুল কাদির ব্যবসাপাতি ছেড়ে আলমনগর গ্রামে ফিরে গেছেন। উদ্বিগ্ন কাদির বলেন, ‘মানুষ নাই, ব্যবসাপাতি বন্ধ। পুঁজি খেয়ে সংসার চলে। সামনে যে কী আছে, ভাবতেও পারছি না।’

‘উগারে’ হাত, ধন্দে মানুষ
রাতারগুল থেকে বিছনাকান্দি যেতে আরেক পথে পড়ে একটি ব্যস্ত গ্রামীণ হাট। নাম শালুটিকর। গোয়াইনঘাটসহ তিনটি উপজেলার মিলনস্থলে এই হাট। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়ক লাগোয়া। সড়কের আশপাশে পানি। শালুটিকরের সবচেয়ে জমজমাট ঐতিহ্যবাহী ‘নাওবাজার’ এখন সড়কমুখী। ৪ জুলাই সেখানে দেখা যায়, হাটে নতুন নৌকা তুলে ক্রেতা পাচ্ছিলেন না নৌকার মিস্ত্রি। সময় কাটাতে নৌকার এক পাশে বসে বইঠা তৈরির কাজ করছিলেন তিনি। এক ক্রেতা নৌকার বদলে ঘুরেফিরে শুধু বইঠার দরদাম করেন। ‘নাও কিনবার আগে কিতা বইঠা কিনতায় নি?’ বলে ফোড়ন কাটেন ওপাশ থেকে একজন।

এ কথার পাল্টা কিছু বলতে গেলে নির্ঘাত ঝগড়া লেগে যেত। কিন্তু দেখা গেল, টিপ্পনী শোনা লোকটি চুপচাপ। কোনো কথা না বাড়িয়ে জড়সড় ভাব নিয়েই স্থান ত্যাগ করেন। কথা বলে জানা গেল, তাঁর নাম নুরুল ইসলাম (৪৫)। দোকানির শ্লেষের কারণ জানতে চাইলে চাপা গলায় বলেন, ‘আমরার উগারে হাত লাগে তো আঢ় (আষাঢ়) মাস গেলে। অখনই উগারে হাত লাগি গেছে। ধান বেচার কিছু জমাইল (সঞ্চয়) টেখা আছিল। ই টেখা জমাইল রাখতাম না একখান নাও কিনতাম—এই নিয়াই ধন্দ (সংশয়)।’

বর্ষায় হাওর-নদীময় সিলেটের গোয়াইনঘাটের যাতায়াতের অন্যতম প্রধান মাধ্যম নৌকা। পানি বাড়লে নৌকার কদরও বাড়ে। ভালো কাঠে তৈরি নৌকার দাম বেশি। ১২ ফুট প্রস্থ ও আড়াই ফুট লম্বা প্রতিটি নতুন নৌকার দর ৪-৮ হাজার টাকা। পুরোনো নৌকাও বিক্রি হয়। এগুলোর দর ৩-৬ হাজার টাকা। করোনার কারণে আয়-রোজগার নেই বলে অনেকে গোলার ধান বেচে নৌকা কিনতে এসেছেন হাটে। কিন্তু শেষ সম্বল এই ধানের টাকায় নৌকা কিনে ফেললে সংসার চালাবেন কী দিয়ে—এই ধন্দে অনেকে হাটে ঘোরাঘুরি করেও নৌকা না কিনেই বাড়ি ফিরছেন। সম্প্রতি শালুটিকর নাওবাজারে। ছবি: আনিস মাহমুদ
বর্ষায় হাওর-নদীময় সিলেটের গোয়াইনঘাটের যাতায়াতের অন্যতম প্রধান মাধ্যম নৌকা। পানি বাড়লে নৌকার কদরও বাড়ে। ভালো কাঠে তৈরি নৌকার দাম বেশি। ১২ ফুট প্রস্থ ও আড়াই ফুট লম্বা প্রতিটি নতুন নৌকার দর ৪-৮ হাজার টাকা। পুরোনো নৌকাও বিক্রি হয়। এগুলোর দর ৩-৬ হাজার টাকা। করোনার কারণে আয়-রোজগার নেই বলে অনেকে গোলার ধান বেচে নৌকা কিনতে এসেছেন হাটে। কিন্তু শেষ সম্বল এই ধানের টাকায় নৌকা কিনে ফেললে সংসার চালাবেন কী দিয়ে—এই ধন্দে অনেকে হাটে ঘোরাঘুরি করেও নৌকা না কিনেই বাড়ি ফিরছেন। সম্প্রতি শালুটিকর নাওবাজারে। ছবি: আনিস মাহমুদ

সিলেট অঞ্চলে ধানের গোলাকে বলা হয় ‘উগার’। ফসলি হাওরে এবার কোনো দুর্যোগ ছাড়াই বোরো ধান ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছে। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ থেকে শুরু করে সাধারণ কৃষকের ঘরে ধান আছে উগারে। এ নিয়ে সবার মনে স্বস্তি। কিন্তু করোনাকালে এই স্বস্তি প্রায় উধাও। কর্মহীন সময়ে ভবিষ্যৎ চিন্তায় সব পেশার মানুষ যেন মনমরা হয়ে আছেন। সঞ্চয় বলতে উগারের ধান ভাঙিয়ে চলছেন এখন।

নৌকা কিনতে গিয়ে বইঠার দরদাম করা নুরুল ইসলামের ধন্দ করোনাকালের জাঁতাকলে পড়ে। বাড়ি তাঁর সিলেটের বিশ্বনাথ। স্ত্রী, চার ছেলেমেয়ের পরিবার। বর্ষাকালে মুদি দোকানদারি করেন। দোকানপাট খোলা আর বন্ধ রাখার সময় বেঁধে দেওয়ায় তিনি পড়েছেন বিপাকে। কেনাবেচা নেই বলে দোকানে নতুন পণ্য তুলতে পারছেন না। বর্ষায় একটি নৌকা কিনে বিকল্প রোজগারের মনস্থির করে হাটে এসেছেন। উগারের ধান বিক্রির টাকা খরচ করবেন কি না, এ নিয়ে তাঁর দোলাচল শেষমেশ আর কাটেনি। কেনা হয়নি বইঠা-নৌকা কোনোটাই।

‘নাওবাজার জমছে তো মানুষ সুখশান্তিতে আছে’ স্থানীয়দের অনেকেরই এমন বিশ্বাস চলে আসছে বহু বছর ধরে। পানি বাড়লে নৌকার কদর বাড়ে। কিন্তু এবার মন্দা। একটি ভ্যানগাড়ি দিয়ে তিনটি নৌকা একসঙ্গে হাটে তুলে এনে ‘নাও কিনলে বইঠা ফ্রি’ বলছিলেন ইছাকলস গ্রামের শাহজাহান। ততক্ষণে একটি বিক্রি করেছেন। ফেরার পথে শাহজাহান বলেন, ‘রোগটার (কোভিড-১৯) লাগি বাইরের মানুষ কম। নাও কেনায় টান নাই।’

দুশ্চিন্তায় কৃষক-শ্রমিক একাকার
গোয়াইনঘাট উপজেলায় ২০ একরের বেশি জলমহাল আছে ৩৫টি। ২০ একরের নিচে ১২০টি। এই জলমহালগুলো বর্ষাকাল শেষে ফসলি জমিতে রূপ নেয়। চাষবাস হয় বোরো ও আউশ ধান। উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, ২৭ হাজার ৩২৬ হেক্টর বোরো জমিতে এবার ৭ হাজার ৯৯০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে। বোরোর পর আউশ উৎপাদনও প্রায় ৭ হাজার মেট্রিক টন। গেল বোরো মৌসুমে ফলন ভালো হওয়ায় অধিকাংশ কৃষক পরিবারের উগারে ধান মজুত আছে। এই নিয়ে স্বস্তির সময়ে করোনা পরিস্থিতিতে অস্বস্তির মধ্যে পড়েছেন মানুষ।

শালুটিকর থেকে তোয়াকুল বাজারে গিয়ে দেখা গেল, রাস্তার পাশে চাটাই ফেলে অবেলায় ধান শুকাচ্ছেন অনেকেই। এই বৃষ্টি এই রোদ, বর্ষার এমন প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছিল তাঁদের ধান শুকানোর পালা। আরেক পাশে ভ্রাম্যমাণ ধান ভানার কল। জানতে চাইলে ‘উগারের ধান ভাঙাচ্ছি’ বলে জানান কৃষক আবদুল হাকিম। উগারের ধান তো বর্ষা শেষে ভাঙানোর কথা, এখন কেন? প্রশ্ন শুনে ধান ভাঙার কলের পাশে বসে হিসাব দিলেন হাকিম।

হাকিমের যৌথ পরিবার। সদস্য সংখ্যা ২০। এবার ফসল ভালো হওয়ায় ১২০ মণ ধান উগারে রেখেছিলেন। যৌথ পরিবারে তিনিসহ আরও ৪ জন রোজগারে যুক্ত। ৫ জনই অন্যান্য বছর বর্ষাকালে পাথরকোয়ারিতে ‘বারকি’ নৌকা বাইতেন। করোনা পরিস্থিতিতে কোয়ারি বন্ধ। তাই বারকি নৌকা বেয়ে আয়ের সুযোগ নেই। উদ্বিগ্ন হাকিম বলেন, ‘উগার ভাইঙা খাইরাম আর চিন্তা কররাম, উগার খালি অইলে কি তা করমু।’

এবার বেরো ধানের ফলন ভালোই হয়েছে সিলেটের গোয়াইনঘাটের জলমহালগুলোতে। ধান ঘরে তোলার পর কৃষকঘরের সঞ্চয় বলতে এই গোলাভরা ধান। করোনার কর্মহীন সময়ে গোলায় হাত পড়েছে। ধান শুকিয়ে বিক্রির জন্য বাড়ির সামনে ভ্রাম্যমাণ কলে ভাঙাচ্ছেন। সম্প্রতি সিলেটের গোয়াইনঘাটের তোয়াকুলে। ছবি: আনিস মাহমুদ
এবার বেরো ধানের ফলন ভালোই হয়েছে সিলেটের গোয়াইনঘাটের জলমহালগুলোতে। ধান ঘরে তোলার পর কৃষকঘরের সঞ্চয় বলতে এই গোলাভরা ধান। করোনার কর্মহীন সময়ে গোলায় হাত পড়েছে। ধান শুকিয়ে বিক্রির জন্য বাড়ির সামনে ভ্রাম্যমাণ কলে ভাঙাচ্ছেন। সম্প্রতি সিলেটের গোয়াইনঘাটের তোয়াকুলে। ছবি: আনিস মাহমুদ

পূর্ব জাফলংয়ের আসামপাড়ার কৃষক শফিকুল সরকারের (৪০) কাছেও উগার ভেঙে খাওয়ার কথা শোনা গেল। মা, স্ত্রী, ২ মেয়েসহ ৫ সদস্য নিয়ে তাঁর সংসার। তিন বিঘা জমিতে বোরো চাষ করে ৩৫ মণ ধান তুলেছেন তিনি। এই ধানে ঘরের খাবারের অন্তত ছয় মাস চলার কথা। কিন্তু করোনার ফলে কোনো আয়রোজগার না থাকায় ২ মাসের মাথায় ৩ বার উগার থেকে ধান বিক্রি করেছেন। ৭০০ টাকা মণ ধরে ৩ মণ বিক্রি করে কোনোমতে চলছেন। শফিকুল বলেন, ‘করোনার কারণে দিনটা নিদানের মতোই কাটছে। ৫৩ কেজি আমনের বীজ রোপণ করছিলাম। ঢলের বন্যায় এইগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে।’

জাফলংয়ের পিয়াইন নদ থেকে পাথর তোলার কাজ করে সংসার চালান মিঠু সরকার (২১)। বাড়ি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ এলাকায়। জাফলংয়ের মামার দোকান এলাকার একটি কলোনিতে ভাড়া করা ঘরে বসবাস করছেন। মা, বাবা ও ৩ ভাই নিয়ে তাঁর বড় পরিবার। সদস্যসংখ্যা ১০। দুই ভাই রুবেল সরকার ও জুয়েল সরকারের সঙ্গে পাথরশ্রমিকের কাজ করেন মিঠু। করোনার আগে পাথরকোয়ারিতে শ্রমিকের কাজ করে তাঁরা জনপ্রতি ৭০০ টাকা রোজগার করতে পারতেন। এতে ভালোভাবেই চলত সংসার খরচ। এখন কোনো কাজ না পেয়ে তাঁরা ট্রাকে পাথর তোলা ও নামানোর কাজ করছেন। দৈনিক রোজগার জনপ্রতি ৩০০ টাকা। কোনো দিন কাজ না পেয়ে খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে। মিঠু সরকার বলেন, ‘কাজকামের সুযোগ থাকাটা চাই। তা না হলে করোনায় না, মরতে অইব না খাইয়া।’

২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাফলংকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া—ইসিএ (পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা) ঘোষণা করায় জাফলংয়ের পাথরকোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখা হয়েছে। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এখন বিছনাকান্দি পাথরকোয়ারিও বন্ধ। দুই কোয়ারিকেন্দ্রিক অন্তত ২৫ হাজার শ্রমিক এখন বেকার। এ বিষয়ে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নাজমুস সাকিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাথরশ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। করোনা পরিস্থিতির কারণে সেই সব উদ্যোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পাথরশ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের বিষয়টি নিয়ে আবার কাজ করবে প্রশাসন।’

সীমান্ত এলাকায় অন্য উদ্বেগ
সীমান্ত উপজেলা গোয়াইনঘাটের উত্তর দিক পুরোটা ভারতের মেঘালয় রাজ্যবেষ্টিত। শালুটিকর থেকে সীমান্তবর্তী বিছনাকান্দির হাদারপাড় যেতে পথে তিনটি হাট আর অর্ধশত গ্রাম পাড়ি দিতে হয়। করোনার প্রভাবে আয়রোজগারে ভাটা পড়লেও গ্রামের মানুষের মধ্যে কোথাও করোনা নিয়ে বাড়তি সতর্কতা দেখা যায়নি। হাদারপাড় পেরিয়ে একটি সেতুতে দেখা গেল, মুখে গামছা পেঁচিয়ে তিনজন কথা বলছেন। কাছে গিয়ে জানা গেল, তাঁদের কথার বিষয় করোনা নয়, সীমান্ত পরিস্থিতি।

তাঁদের কথা, গোয়াইনঘাটে করোনায় এ পর্যন্ত (২৭ জুলাই পর্যন্ত) মারা গেছেন দুজন। আর সীমান্ত এলাকায় গুলিতে মারা গেছেন পাঁচজন। করোনা পরিস্থিতি ছাপিয়ে উদ্বেগ বেশি সীমান্ত নিয়ে। রুস্তমপুর গ্রামের লিয়াকত আলী মুখ থেকে গামছা সরিয়ে বলেন, ‘রোগশোকে সব বন্ধ। কোনো কামকাজ নাই। এই অবস্থায় আমরা আছি বড় এক ডরের মইধ্যে। তা অইল জান বাঁচানো।’

রাস্তার পাশে চাটাই ফেলে অবেলায় ধান শুকাচ্ছেন অনেকেই। এই বৃষ্টি এই রোদ—বর্ষার এমন প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছিল তাঁদের ধান শুকানোর পালা। আরেক পাশে চলছে ভ্রাম্যমাণ ধান ভানার কল। গোলার ধান যদিও বর্ষা শেষে ভাঙানোর কথা, কিন্তু করোনায় আয়ের পথ বন্ধ বলে এই ধান বিক্রির টাকাতেই চলছে অনেকের সংসার খরচ। সম্প্রতি সিলেটের গোয়াইনঘাটের তোয়াকুলে। ছবি: আনিস মাহমুদ
রাস্তার পাশে চাটাই ফেলে অবেলায় ধান শুকাচ্ছেন অনেকেই। এই বৃষ্টি এই রোদ—বর্ষার এমন প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছিল তাঁদের ধান শুকানোর পালা। আরেক পাশে চলছে ভ্রাম্যমাণ ধান ভানার কল। গোলার ধান যদিও বর্ষা শেষে ভাঙানোর কথা, কিন্তু করোনায় আয়ের পথ বন্ধ বলে এই ধান বিক্রির টাকাতেই চলছে অনেকের সংসার খরচ। সম্প্রতি সিলেটের গোয়াইনঘাটের তোয়াকুলে। ছবি: আনিস মাহমুদ

করোনাকালে সিলেট অঞ্চলে সীমান্ত এলাকায় প্রথম বাংলাদেশি নিহতের ঘটনা ঘটে গত ২৩ মে। জাফলং সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে কালা মিয়া (৩৭) নামের একজন পাথরশ্রমিক নিহত হন। তিনি জাফলংয়ের নয়াবস্তি এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। ওই ঘটনার ১৮ দিনের মাথায় গত ১০ জুন বিছনাকান্দির পাশের কুলুমছড়া সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় খাসিয়াদের গুলিতে মিন্টু মিয়া (২৬) নামের একজন নিহত হন। তিনি গরু চরাতে সীমান্ত এলাকায় গিয়েছিলেন। ১০ দিনের মাথায় সীমান্তে বাংলাদেশি নিহতের তৃতীয় ঘটনা ঘটে বিছনাকান্দির পশ্চিমে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কলাইরাগ সীমান্তে। ভারতীয় খাসিয়াদের গুলিতে বাবুল বিশ্বাস (৩৪) নামের এক বাংলাদেশি নিহত হন। চতুর্থ ঘটনা ঘটে গত ২ জুলাই বিছনাকান্দি পাশের দমদম এলাকায়। ভারতীয় খাসিয়াদের গুলিতে নিহত হন সিরাজ মিয়া (৪৫) নামের এক দিনমজুর। তিনিও গরু চরাতে সেখানে গিয়েছিলেন। সবশেষ গত ১১ জুলাই উৎমা সীমান্তে বাবুল হোসেন (৩৫) নামে আরও একজন ভারতীয় খাসিয়াদের গুলিতে মারা গেছেন।

নিহত সিরাজ মিয়ার এক প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা হয়। কথায় ক্ষোভ ঝরল। তাঁর কথা, ‘আমরা আসলে করোনা, কামকাজ না থাকার চাইতে বেশি চিন্তাত আছি বর্ডার এলাকার পরিবেশটা নিয়া। গরু চরাতে গেলেই ঘটে অঘটন। মরি গেলে জুটে নানা অপবাদ। এর একটা সুরাহা চাই। না হলে মানুষের মনে অসন্তোষ অন্য কিছুর জন্ম দিত পারে।’

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৪৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আহমেদ ইউসুফ জামিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঁচজন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার প্রতিবাদ আমরা করেছি। বিএসএফের হাতে একজন নিহত হওয়ার ঘটনার কড়া নিন্দা আর ভারতীয় খাসিয়াদের হাতে চারজন নিহতের ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের তাগাদাও দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সীমান্ত এলাকার মানুষকে সীমান্ত আইন বিষয়ে আরও সচেতন করতে বিশেষ প্রচারণা চালানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।’