জ্বালানি তেলের কর কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি এড়ানো যেত: সিপিডি

‘জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি : এখন এড়ানো যেত কি’ শীর্ষক সিপিডির আলোচনা
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

জ্বালানি খাতের সংস্থাগুলোর দুর্নীতি-অপচয় বন্ধ করতে না পেরে জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্যবৃদ্ধি জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। গবেষণা সংস্থাটি বলছে, জ্বালানি তেলের কর প্রত্যাহার বা কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি এড়ানো যেত। কিন্তু এটি এনবিআরের রাজস্বের বড় উৎস, তারা ছাড় দেবে না।

‘জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি: এখন এড়ানো যেত কি?’ শীর্ষক এক নিবন্ধে এমনটাই জানিয়েছে সিপিডি। আজ রাজধানীর ধানমন্ডির নিজস্ব কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি বলেছে, ভর্তুকি সম্পদের অপচয় করে। এ ছাড়া এটি ধনী-গরিব সবাই পায়। তাই ভর্তুকি তুলে দিতেই হবে। এটি আইএমএফের শর্তে হোক বা না হোক। তবে এটি ধীরে ধীরে করা যেত।

জ্বালানি তেলের দাম পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে সিপিডির নিবন্ধে বলা হয়, জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানোর ঘটনা দেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ কারণে অর্থনীতি এখন চরম চাপে। ধাপে ধাপে নানাভাবে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমন সময়ে এ মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। সবচেয়ে বেশি ভুগবে নিম্ন আয়ের ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ। বাজারে সব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। দেশে কৃষি উৎপাদন কমলে আমদানি বাড়বে। শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হলে রপ্তানি কমবে।

বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, ভর্তুকি প্রত্যাহার সমর্থন করি কিন্তু যেভাবে করা হয়েছে, এটাকে সমর্থন করি না। দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে খারাপ সময়ে সরকার জ্বালানি তেলের কর তুলে দিতেই পারে। বরং দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ওপর পরোক্ষ কর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা ভয়ংকর বৈষম্যমূলক। ধনীর কিছু হবে না, গরিব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সিপিডির নিবন্ধে বলা হয়, গত মে পর্যন্ত শেষ আট অর্থবছরে ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি। সরকার জ্বালানি তেলে প্রায় ৩৪ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের কর নেয়। বিপিসির কাছ থেকে প্রতিবছর লভ্যাংশ নিচ্ছে। উদ্বৃত্ত অর্থ হিসাবে বিপিসির তহবিল থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে সরকার।

সিপিডির আলোচনা সভায় নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, করোনা মহামারির প্রভাবে অনেক মানুষ এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে অনেকে। তাদের স্বস্তি না দিয়ে উল্টো চাপ তৈরি করা হচ্ছে।

সাবেক কৃষিসচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, একবারে এত বেশি দাম বাড়ানোর মতো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এখনো আসেনি। ধান চাষে প্রতি বিঘা জমিতে এক হাজার টাকা খরচ বাড়বে কৃষকের। এ খাতে ১৫ লাখ কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়, যার ৭৫ শতাংশ ডিজেলচালিত। এখানে অন্তত আগের দামে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ধানের উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশ বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে।

এ সময়ে মূল্যবৃদ্ধি এড়ানো গেলে রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য সহায়ক হতো বলে মনে করছেন বিকেএমইএ সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান। তিনি বলেন, গ্যাস সরবরাহ না থাকায় ডিজেলের ব্যবহার বেড়েছে কারখানায়। নতুন দামে কিনে কারখানা চালানো সম্ভব নয়। দুই মাস আগেই দাম কমিয়েছে ক্রেতারা। এদিকে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির কারণে সামনে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো লাগতে পারে।

প্রায় ৩৫০ যাত্রী ও ১২টি দূরপাল্লার বাস কাউন্টারে গিয়ে কথা বলেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দিনে শহরে যাতায়াত খরচ বেড়েছে গড়ে ৭০ থেকে ২০০ টাকা। আর দূরপাল্লার বাসে খরচ বেড়েছে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা। শহরে প্রতি কিলোমিটারে আড়াই টাকা নির্ধারণ করা হলেও তিন থেকে সাত টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে বিভিন্ন পরিবহন।

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি অবশ্যই এড়ানো যেত বলে দাবি করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার মানে ভোক্তার ওপর দায় চাপানো নয়, অপচয় কমানো। বিপিসির মুনাফার টাকা গেল কোথায়। তাদের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা দরকার। এটা আইএমএফের জন্য হলেও ভোক্তার ওপর না চাপিয়ে আরও কিছুদিন চালিয়ে নেওয়ার আর্থিক সক্ষমতা বিপিসির ছিল।

বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু সুপারিশ করেছে সিপিডি। এতে বলা হয়, মূল্যবৃদ্ধি পুনর্বিবেচনা করে এটি কমিয়ে আনা। খোলাবাজারে কম দামে সরকারের পণ্য বিক্রি বাড়ানো। রেশন কার্ডের সংখ্যা আগের চেয়ে বাড়ানো। শুধু দরিদ্র নয়, নিম্ন আয়ের মানুষদেরও দিতে হবে। আর এটা যাঁর প্রয়োজন, তাঁকে দেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা। মধ্যমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে প্রাথমিক জ্বালানি নিশ্চিত করতে দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।