ধর্ষণ মামলা: সন্তানটির ভরণপোষণের ব্যয় নির্বাহ করতে নির্দেশ
ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া একটি সন্তানের ভরণপোষণের ব্যয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৩ ধারা অনুসারে বহন করতে নির্দেশ দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। ওই ধারার বিধান অনুসারে ভরণপোষণের এই ব্যয় আসামির (ধর্ষণকারী) কাছ থেকে আদায় করা যাবে, বলছেন আইনজীবীরা।
১৮ বছর আগে ধর্ষণের অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় করা এক মামলায় আসামিকে বিচারিক আদালত খালাস দিয়েছিলেন। সেই খালাসের রায় বাতিল করে আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে আজ মঙ্গলবার এ রায় দেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীর (মামলার বাদী) করা আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান ও বিচারপতি ফাহমিদা কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৩ ধারায় ‘ধর্ষণের ফলশ্রুতিতে জন্মলাভকারী শিশু সংক্রান্ত বিধান’ উল্লেখ রয়েছে। ধারাটির ১৩(১)(গ)–এর ভাষ্য, ধর্ষণের কারণে কোনো সন্তান জন্মলাভ করলে সন্তানের ভরণপোষণের ব্যয় রাষ্ট্র বহন করবে। ১৩(১)(ঘ) অনুসারে, সন্তানের ভরণপোষণের ব্যয় তার বয়স একুশ বছর পূর্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রদেয় হবে, তবে একুশ বছরের বেশি বয়স্ক কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে তার বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত এবং পঙ্গু সন্তানের ক্ষেত্রে তিনি স্বীয় ভরণপোষণের যোগ্যতা অর্জন না করা পর্যন্ত প্রদেয় হবে। আর ১৩(৩) বিধান অনুসারে, কোন সন্তানকে ভরণপোষণের জন্য প্রদেয় অর্থ সরকার ধর্ষকের কাছ হতে আদায় করতে পারবে এবং ধর্ষকের বিদ্যমান সম্পদ হতে ওই অর্থ আদায় করা সম্ভব না হলে ভবিষ্যতে তিনি যে সম্পদের মালিক বা অধিকারী হবেন, সেই সম্পদ হতে তা আদায়যোগ্য হবে।
আইনজীবীদের তথ্য অনুসারে, বিয়ের আশ্বাস দিয়ে ২০০৫ সালে হবিগঞ্জের কাছুম আলী (২২) ২০ বছর বয়সী এক তরুণীকে ধর্ষণ করেন। সে বছরের ৫ ডিসেম্বর ভুক্তভোগী তাঁর গর্ভে সন্তান আসার বিষয়টি নিশ্চিত হন। বিষয়টি কাছুমকে জানালে তিনি ওই নারীকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানান। উল্টো গর্ভপাতের পরামর্শ দেন। তবে ভুক্তভোগী তা প্রত্যাখ্যান করেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় কাছেম আলীর বিরুদ্ধে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানায় ২০০৬ সালের ২১ জুলাই মামলা করেন ভুক্তভোগী। এরই মধ্যে ওই তরুণী সন্তানের জন্ম দেন।
ওই মামলায় ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি রায় দেন হবিগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২। রায়ে কাছুম আলী খালাস পান। এই রায় বাতিল চেয়ে ওই বছরই হাইকোর্টে আবেদন করেন ভুক্তভোগী ও মামলার বাদী। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৩০ মে হাইকোর্ট রুল দেন। পাশাপাশি মামলার নথি তলব করেন। রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে আজ রায় দেওয়া হলো।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল শরীফুজ্জামান মজুমদার। ভুক্তভোগী নারীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম। আসামিপক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. আক্তারুজ্জামান।
পরে আবেদনকারীর আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আসামিকে খালাসের রায় বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগীর সন্তানের ভরণপোষণের ব্যয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৩ ধারা অনুসারে বহন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইনের বিধান অনুসারে ধর্ষণের কারণে কোনো সন্তান জন্ম নিলে ওই সন্তানের ভরণপোষণের ব্যয় রাষ্ট্র বহন করবে। সন্তানকে ভরণপোষণের প্রদেয় ওই অর্থ সরকার ধর্ষকের কাছ থেকে আদায় করতে পারবে।
রায় যুগান্তকারী উল্লেখ করে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচারিক আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দিয়েছেন হাইকোর্ট। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১এ ধারায় আবেদন (খালাসের রায় বাতিল চেয়ে আবেদন) করা হলে সাধারণত মামলা পুনর্বিচারের জন্য নিম্ন আদালতে পাঠানো হয়। তবে অপরাধে আসামির সম্পৃক্ততা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় হাইকোর্ট রায় (নিম্ন আদালতের) বাতিল আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন, যা দৃষ্টান্তমূলক।’