নারী নির্যাতন বাড়লেও সরকারি পদক্ষেপ কম

পাঁচ বছর আগের তুলনায় এখন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গড়ে মাসে ৩৫০টি মামলা বেড়েছে।

নাজমা বেগম (৫৭) নিজে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন। গত ১৭ বছরে নিজের দুই মেয়ে ও নাতনিকেও একইভাবে পারিবারিক সহিংসতা এবং যৌতুকের শিকার হতে দেখেছেন। যৌতুক দিতে না পারায় তাঁর এক মেয়েকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ১৬ বছরের মেয়ে সামিনাকে ২০০৫ সালের ৭ জুন স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন পুড়িয়ে হত্যা করেছে।

সাভারের কাউনিয়া গ্রামের নাজমা বেগম ২ ডিসেম্বর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়ের কথা মনে পড়লে আমার আর দুনিয়ার কথা ভুলে যাই। আমি তো জীবিত থেকেও মরে আছি।’

স্বামীর মারধরে অতিষ্ঠ হয়ে ১৫ বছর আগে অন্তঃসত্ত্বা এক গৃহবধূ স্বামীর সংসার ছেড়ে সাতক্ষীরার তালায় বাবার বাড়িতে চলে যান। এখন ভিক্ষা করে চলেন। তাঁর সেই সংসারের মেয়েটি এখন কিশোরী। প্রতিবেশী এক বয়স্ক ব্যক্তির হাতে ধর্ষণের শিকার হয়ে এখন সে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গত শনিবার মুঠোফোনে ওই মা প্রথম আলোকে বলেন, সেই ধর্ষক এখন পলাতক। তিনি (গৃহবধূ) দিশাহারা।

অর্থনৈতিক সংকটে সামাজিক চাপের মুখে পারিবারিক নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা বেশি হয়েছে। ওই সময়ের সঙ্গে তুলনা করে এখন নারী নির্যাতন কমেছে বলে সন্তোষ প্রকাশের সুযোগ নেই।
খন্দকার ফারজানা রহমান, চেয়ারম্যান অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে পরবর্তী প্রতিবছরেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা বেড়েছে। এর মধ্যে ব্যাপক করোনা সংক্রমণের দুই বছর ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি ৩৯ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৩৬ শতাংশ বেশি মামলা হয়। ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছরের ১০ মাসে মামলা বেড়েছে ৫ শতাংশ।

শুধু নাজমা বা তাঁর মেয়ে-নাতনি নন, নারী ও শিশু নির্যাতনের ক্ষত এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে চলছেন দেশের অসংখ্য নারী।

সরকারি-বেসরকারি তথ্য বলছে, পাঁচ বছর আগের তুলনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এখন মাসে গড়ে ৩৫০টি মামলা বেড়েছে। বিদ্বেষমূলক মন্তব্য, প্রতারণা, যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের আরেকটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। চলতি বছরের শুরুর দিকের তুলনায় শেষের দিকে অনলাইনে নির্যাতনের অভিযোগ বেড়েছে ২৫ শতাংশ।

আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সামাজিক প্রেক্ষাপট তৈরির বড় কাজটি করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। অথচ নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কার্যক্রমে মন্ত্রণালয়ের বাজেট গত ছয় বছরের মধ্যে এখন সবচেয়ে কম। এ সময়ে বাজেট কমেছে ৬৩ শতাংশ।

বিশ্বে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে নারী ও শিশু নির্যাতন হয় না। প্রধানমন্ত্রী নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। নারী নির্যাতন বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা আছে।
আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

বাস্তবে ও ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে নির্যাতন বাড়ছে

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে পরবর্তী প্রতিবছরেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা বেড়েছে। এর মধ্যে ব্যাপক করোনা সংক্রমণের দুই বছর ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি ৩৯ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৩৬ শতাংশ বেশি মামলা হয়। ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছরের ১০ মাসে মামলা বেড়েছে ৫ শতাংশ।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় ধর্ষণ, যৌতুকের জন্য নির্যাতন ও হত্যা, অপহরণ, যৌন নিপীড়ন, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, দাহ্য পদার্থ দিয়ে ক্ষতি করা, ভিক্ষাবৃত্তির উদ্দেশ্যে শিশুর অঙ্গহানির মতো অপরাধ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ২১ ডিসেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে নারী ও শিশু নির্যাতন হয় না। প্রধানমন্ত্রী নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। নারী নির্যাতন বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা আছে।

সাধারণত নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা গুরুতর হলে গণমাধ্যমে সংবাদ হয়। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ৯টি পত্রিকা ও কিছু অনলাইন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে তথ্য নিয়ে জানিয়েছে, চলতি বছরের গত ১১ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ৩ হাজার ১৮৪টি খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশই ধর্ষণের খবর।

অনলাইনেও নারীর প্রতি সহিংসতা ব্যাপক বেড়েছে। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট সেন্টার ফর উইমেনের (পিসিএসডব্লিউ) তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভুয়া আইডি, আইডি হ্যাক, ব্ল্যাকমেলিং, মুঠোফোনে হয়রানি, আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানোর অভিযোগ করেছেন ৮ হাজার ৭১৫ নারী। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৬৬১টি অভিযোগ এলেও গত নভেম্বরে এসেছে ৮২৬ অভিযোগ।

পিসিএসডব্লিউর কর্মকর্তারা বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারী নির্যাতন বাড়ছে। নিজেদের পরিচয় গোপন করে অপরাধীরা অনলাইন মাধ্যমে সহজেই নারীদের তথ্য সংগ্রহ করে। পরে তাঁদের নানাভাবে হয়রানি করে।

বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে হতাশা

নাজমা বেগমের মেয়ে সামিনাকে পুড়িয়ে হত্যার মামলাটি পরিচালনা করছে বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। মামলার ১৩ বছর পর ২০১৮ সালে আদালত সামিনার স্বামী জাফরসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। তাঁদের মধ্যে জাফরসহ তিনজন কারাগারে। বাকিরা পলাতক। রায় কার্যকর হতে এখনো বহু পথ বাকি। দীর্ঘদিন পরও আসামিদের সাজা কার্যকর না হওয়ায় হতাশ নাজমা বেগম।

২৫ বছর আগে স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের মামলা করে চাপের মুখে এক বছরের মধ্যে মামলা তুলে নেন এক নারী। তিনি প্রথম আলোকে আক্ষেপ করে বলেন, ‘অনেক অভিমান হয়। পুরোনো কথা আর মনে করতে চাই না।’

২০১৩ সালে চাচার বিরুদ্ধে শিশুসন্তানকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছিলেন রাজধানীর এক মা। মামলাটি আদালতে এখনো সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে। ওই মা প্রথম আলোর কাছে বিচারের ধীরগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

পুলিশ, আইনজীবী ও সরকারি কৌঁসুলিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার বিচার ট্রাইব্যুনালে ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও তা হয় না। মামলার তদন্তের সময় মেডিকেল সনদ, ডিএনএ প্রতিবেদন (ধর্ষণের মামলায় আবশ্যক) পেতে দেরি হয়। বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর পর চিকিৎসক, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও মামলার বিভিন্ন সাক্ষীর সাক্ষ্য পেতে বছরের পর বছর চলে যায়।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন প্রথম আলোকে বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগের জন্য যেসব প্রক্রিয়া থাকতে হবে, তা নেই। বিচারের ধাপগুলোতে যাঁরা ভুক্তভোগীদের সহায়তা করবেন, তাঁদের জবাবদিহি থাকা দরকার। মামলাগুলো দীর্ঘদিন ঝুলে থাকে বলে অপরাধীরা মনে করে, ‘যা-ই করি না কেন, পার পেয়ে যাব’।

উচ্চ আদালতের তথ্য অনুসারে, এ বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের ৯৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৩১। সবচেয়ে বেশি ১৮ হাজার ২৫টি মামলার বিচার চলছে ঢাকার ৯টি ট্রাইব্যুনালে।

নির্যাতন প্রতিরোধে কমেছে বাজেট

পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনি কাঠামোয় লিঙ্গবৈষম্য নারী নির্যাতন বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন নারী আন্দোলনে যুক্ত ব্যক্তিরা। গত জুলাইয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) জেন্ডার অসমতাবিষয়ক ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২২’-এ বলা হয়েছে, ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম। অথচ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৪৮তম।

লিঙ্গবৈষম্য ও নারী নির্যাতন বাড়লেও অর্থনৈতিক সংকটে কাটছাঁটে পড়েছে নারীবিষয়ক প্রকল্প ও কর্মসূচিগুলো। ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম’ প্রকল্পটিকে সরকার ‘ফ্ল্যাগশিপ’ (অতিগুরুত্বপূর্ণ) বলে থাকে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ১১টি মন্ত্রণালয় নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সমন্বিত সেবা দেয়। গত ছয় বছরের মধ্যে চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) এই প্রকল্পে সবচেয়ে কম ১১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

জানতে চাইলে এ প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নাহিদ মঞ্জুরা প্রথম আলোকে বলেন, বাজেট বাড়াতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে জাতীয়, কেন্দ্রীয়, বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। জেলা-উপজেলা কমিটিতে ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫৬টি বৈঠকে উপস্থিত থাকা সাতক্ষীরার একটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি প্রথম আলোকে বলেন, নিয়মিত বৈঠক হলেও এতে ১৩-১৪টি বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা ও মাদক প্রতিরোধ অগ্রাধিকার পায়। নারীর বিষয়ে বেশির ভাগ বৈঠকে কোনো আলোচনাই হয় না।

জানতে চাইলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মুহিবুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, নারী ইস্যুতে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার রয়েছে। বৈঠকের বিষয়ে বিকল্প ভাবা হচ্ছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ এবং যৌতুকবিরোধী জাতীয় কার্যক্রম পরিচালনাসংক্রান্ত আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি ২০২০ সালে পুনর্গঠিত হলেও এ বছরের ১৭ নভেম্বর প্রথম বৈঠক হয়। ৩১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সভাপতি মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী। ওই বৈঠকে উপস্থিত এক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, নারী নির্যাতন বৃদ্ধির বিষয়ে বৈঠকে কমিটির সরকারি সদস্যরা সন্দেহ প্রকাশ করেন। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জরিপের পদ্ধতি নিয়েও তাঁরা প্রশ্ন তোলেন।

নির্যাতন কমেছে বলার সুযোগ নেই

ব্যাপক করোনা সংক্রমণের দুই বছরের তুলনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এখন মামলা কিছুটা কমলেও তা সার্বিকভাবে নারী নির্যাতন কমার চিত্র প্রকাশ করে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান।

প্রথম আলোকে তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সংকটে সামাজিক চাপের মুখে পারিবারিক নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা বেশি হয়েছে। ওই সময়ের সঙ্গে তুলনা করে এখন নারী নির্যাতন কমেছে বলে সন্তোষ প্রকাশের সুযোগ নেই। কারণ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারি ও বিশিষ্ট নাগরিক—দুই পর্যায় থেকেই কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।

খন্দকার ফারজানা বলেন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে শিক্ষাব্যবস্থায় লিঙ্গসমতার পাঠ শেখানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধা, সহমর্মিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে পরিবার থেকেও বড় ভূমিকা রাখতে হবে।