যমজ বোন হলেও নাচে তাঁরা ছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী

নাজনীন মোসাব্বের ও নাজমা সুলতানাছবি: সংগৃহীত

১৯৬৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) উদ্বোধনের সময় চট্টগ্রাম থেকে নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন কামরুন নাহার (রুবি)। তাঁর যমজ মেয়ে নাজনীন মোসাব্বের (রুচি) ও নাজমা সুলতানা (রুপা) নাচে জাতীয় পুরস্কার থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ে পুরস্কার পেয়েছেন। ৫৮ বছর বয়সী এ দুই বোন এখনো পারিবারিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচেন।

নাচ নিয়ে নাজনীন ও নাজমার সঙ্গে কথা হয়। এ নিয়ে মা ও নিজেদের গল্প শোনালেন তাঁরা। জানালেন, মা মারা গেছেন ২০১২ সালে। নানা আবদুল কুদ্দুস ভূঁইয়া সংস্কৃতিমনা ছিলেন। তাঁর উৎসাহেই মা-খালারা করতেন নাচ-গান। আর মা ও খালাদের উৎসাহে তাঁরা দুই বোন প্রথমে বাসায় তাঁদের কাছে এবং পরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নাচের তালিম নেন।

আলাপচারিতায় একপর্যায়ে নাজনীন ফিরে গেলেন শৈশবে, রাজধানীর শান্তিনগরের চামেলিবাগে নানার বাড়ির বড় উঠানে। জানালেন, এলাকার ছোট ছেলেমেয়েদের খেলার জায়গা ছিল এ উঠান। তাঁদের নানা ছিলেন ছোটদের সবার নানা। এই নানার জন্যই তাঁদের শৈশবটা ছিল আনন্দের। নানা একবার ভাবলেন পাড়ার চামেলি খেলাঘরের বাচ্চাদের নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটা অনুষ্ঠান করবেন। সেখানেই নাচবেন নাজনীন ও তাঁর বোন। তাঁরা তাঁদের মায়ের কাছে নাচটি শিখলেন।

উঠানে নাচের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে নাজনীন বলেন, ‘মা “এই ধিতাং ধিতাং বলে...” গানের সঙ্গে নাচটি এত সুন্দর করে শিখিয়েছিলেন যে সেই সাত বা আট বছর বয়সে শেখা নাচটি এখনো মনে আছে।’

নাজনীন বললেন, ‘আমরা খুব ভালো করেই নাচটি শিখেছিলাম। কিন্তু চূড়ান্ত রিহার্সালের দিন উঠানে আমরা নাচের সব মুদ্রা বিসর্জন দিয়ে শুধু চরকির মতো ঘুরছি তো ঘুরছি। হঠাৎই যেন নানার বজ্রকণ্ঠ কানে এল, “কিরে তোরা এবার থামবি, গেট আউট।” পরে অবশ্য টেলিভিশনে আমরা নাচে অংশ নিয়েছিলাম।’

নাজনীন জানালেন, তাঁদের নানা শিক্ষাবিদ হিসেবে ওই সময় রেডিওতে অনুষ্ঠান করতেন। তিনি বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণে পটু ছিলেন। ছিলেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন।

মায়ের সঙ্গে দুই বোন নাজনীন মোসাব্বের ও নাজমা সুলতানা
ছবি: সংগৃহীত

মা প্রসঙ্গে নাজনীন বললেন, ‘আমার মা ঝর্ণা বসাকের সঙ্গে নাচতেন। তিনি যে শুধু নাচতেন, তা-ই নয়, খুব ভালো গান গাইতেনও। বাবা নুরুল মোনেম জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব হিসেবে চাকরিজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। বাবার অফিসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মা গান গাইতেন। বাবা মারা যান ২০০৯ সালে।’ মায়ের সেই সময়ের নাচের ছবি আছে কি না, জানতে চাইলে আক্ষেপ করে বললেন, ‘আহারে, আম্মার একটা ছবি ছিল, ছবিটি হারিয়ে গেছে।’

নাজনীন মোসাব্বের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা এবং বোন নাজমা সুলতানা ইতিহাস বিভাগ থেকে এমএ করেছেন। তাঁরা ছোটবেলায় নৃত্যগুরু জি এ মান্নানের কাছে নাচ শিখেছেন। পরে তাঁর পরিচালনায় ’৭০-এর দশকে বিটিভিতে দুই বোন নাচ করেছেন ছোটদের অনুষ্ঠানে। নৃত্যগুরু লায়লা হাসানের পরিচালনায় বিভিন্ন স্টেজ শো ও বিটিভির নৃত্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন তাঁরা। বড় হয়ে নাচ শিখেছেন নৃত্যগুরু শুক্লা সরকারের কাছে।

নাচে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী

আপন দুই বোন হলেও নাচের বেলায় নাজনীন ও নাজমা হয়ে যেতেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁরা যথাক্রমে ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিশু প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জাতীয় পুরস্কার পান।

বাবার কর্মস্থল কুমিল্লা থেকে অংশ নিয়েছিলেন নাজনীন। আর নোয়াখালী থেকে নাজমা। থানা পর্যায় থেকে প্রথম হয়ে ধাপে ধাপে মহকুমা, জেলা, বিভাগে প্রথম হয়ে জাতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ ঢাকায় আসতে হয়েছিল তাঁদের।

দুজন যমজ বোন—বিভাগীয় পর্যায়ের বিচারকেরা জানতেন না। একই প্রতিযোগী আবার কেন নাচছেন, তা নিয়ে শুরু হয় শোরগোল। পরে বিষয়টি সুরাহা হয়। ১৯৭৮ সালে বোনকে আধা নম্বরে হারিয়ে নাজনীন ঢাকায় আসতে পেরেছিলেন।

আপন দুই বোন হলেও নাচের বেলায় নাজনীন ও নাজমা হয়ে যেতেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁরা যথাক্রমে ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিশু প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জাতীয় পুরস্কার পান।

পরের বছর একইভাবে নাজমা বোনকে আধা নম্বরে হারিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সুযোগ পেয়েছিলেন। এ দুই বোন কুমিল্লা ও নোয়াখালী থেকে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান লাভ করেছিলেন। দুই বছরই প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন তারানা হালিম।

নাজনীন জানালেন, ’৯০-এর দশকে বিয়ের পর একমাত্র ছেলে সৈয়দ মাহাদী হোসেনের জন্মের পর নাচে প্রায় ১৫ বছরের মতো বিরতি দেন। ছেলেটি বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া ও জার্নালিজম বিষয়ে মাস্টার্স করছেন। ছেলে গুলশানের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়তেন। সেই স্কুলেই নাজনীন শিক্ষকতা করেছেন। বাচ্চাদের নাচ শিখিয়েছেন টানা পাঁচ বছর। তারপর আবার বিরতি। তবে ছেলের আগ্রহেই নাজনীন নাচ ছাড়তে পারেননি।

নাজনীন ইন্টারন্যাশনাল ইনার হুইল ক্লাব অব ধানমন্ডি শাখার এক্সিকিউটিভ কমিটি মেম্বার হিসেবে আইএসও পদে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৮ সাল থেকে সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর এটির বড় অনুষ্ঠানে এখনো নাচেন তিনি। ২০২৩ সালে তিনি ‘বিটিআই: দ্য ডেইলি স্টার স্টেলার ওমেন’-এর সার্টিফিকেট অব নমিনেশন মনোনীত হন। একুশে বইমেলায় তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর।

নাজনীন মোসাব্বেরের স্বামী সৈয়দ মোসাব্বের হোসেন চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। নাজনীন জানান, বিয়ের আগেই তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি মারা গেছেন। স্বামী তাঁর নাচ নিয়ে কখনো আপত্তি করেননি। স্বামী বলতেন, নাজনীন যা ভালো মনে করবেন, তা-ই করবেন। তাই বাবা বা স্বামীর পরিবার থেকে কখনো নাচ নিয়ে বাধার সম্মুখীন হননি।

নাজমা সুলতানাও একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, বাচ্চাদের নাচ শিখিয়েছেন। তবে করোনার পর চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। পারিবারিক অনুষ্ঠানে বোনের সঙ্গে নাচলেও বাইরের কোনো অনুষ্ঠানে এখন অংশ নেন না। তিনি জানালেন, তিনি যেবার জাতীয় পুরস্কার পান, সেবার সরকারিভাবে জাপানে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।

নাজমার দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে এবং ছেলের বউ ব্যারিস্টার। ছোট ছেলে ব্যাংকার, কানাডায় থাকেন। নাজমা জানালেন, ছেলের বউ প্রায়ই মন খারাপ করেন, তিনি কেন এখন নাচেন না। নাজমার স্বামী হাইকোর্টের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন অসুস্থতার জন্য এখন আর সেভাবে প্র্যাকটিস করেন না।

নাজমাও বললেন, তিনি স্বামীর পরিবার থেকে নাচ নিয়ে কখনো বাধার সম্মুখীন হননি। নিজে থেকেই এখন নাচ থেকে নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছেন। তিনিও ফিরে গেলেন অতীতে। তিনি বললেন, ‘জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলাম, দ্বিতীয় হয়েছিলাম। বাসা পরিবর্তনের সময় সেই সব ছবি হারিয়ে গেছে। খুঁজলে হয়তো একটা-দুইটা পাওয়া যেতে পারে।’

সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন চিত্রবাংলায় ‘যমজদের বিচিত্র ভুবন’ শিরোনামে এই দুই বোনকে নিয়ে কভার স্টোরি ছাপা হয়েছিল। বিভিন্ন পত্রিকায় দুই বোনের নাচের ছবি ছাপা হয়েছে। ২০২৩ সালে খালাতো বোনের গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে দুই বোন একসঙ্গে নাচেন। দুই বোন জানালেন, চার বোন, দুই ভাইয়ের মধ্যে তাঁদের বড় বোন রিফাত সুলতানা মারা গেছেন। তিনি গান গাইতেন আর তাঁরা দুই বোন নাচতেন। আরেক বোন নাসরিন সুলতানা যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তাঁর দুই মেয়েও সেখানে নাচের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। দুই ভাই ব্যাংকার।

সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন চিত্রবাংলায় দুই বোনকে নিয়ে কভার স্টোরি ছাপা হয়েছিল
ছবি: সংগৃহীত

মেয়েদের নাচ নিয়ে প্রতিবন্ধকতা বেড়েছে

দুই বোন জানান, আগে তাঁরা পরিবারের উৎসাহে ও স্বাধীনভাবে নাচতেন। তবে বর্তমানে পড়াশোনার চাপ, ধর্মীয় কারণসহ নানা কারণে মেয়েদের নাচের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা বেড়েছে।

নাজমা বললেন, নাচের বিভিন্ন সংগঠন হয়েছে; আগে যা ছিল না। তবে অনেক পরিবারই এখন মেয়েদের নাচ শেখাতে তেমন উৎসাহ পাচ্ছে না। নাচ শেখা শুরু করলেও অনেকেই ঝরে পড়ছেন। অথচ নিজেকে ভালো রাখার জন্যই নাচ-গানসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাচ্চাদের যুক্ত রাখা প্রয়োজন।

নাচের ভঙ্গিমায় দুই বোন
ছবি: সংগৃহীত

নাজনীন বললেন, ‘বড় হয়ে গাইড হাউসে ও মহিলা সমিতি মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের গীতিনৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করেছি নৃত্যগুরু শুক্লা সরকারের পরিচালনায়। নিজেরা যেমন অনেক আগ্রহ নিয়ে, আনন্দ নিয়ে নেচে গিয়েছি, তেমনি আমার বাসা থেকেও কোনো বাধার সম্মুখীন হইনি কখনো। বিটিভিতে ঈদের আনন্দমেলায় দুই বোন একসঙ্গে নেচেছি সেই ৮০-৯০ দশকে।’

নাজনীন বলেন, ‘স্কুল বা বাসায় বাচ্চাদের নাচ শেখাতে গিয়ে দেখেছি, নাচ শিখতে শুরু করলেও আস্তে আস্তে বাচ্চাদের সংখ্যা কমতে থাকে। অভিভাবকেরা বিশেষ করে মায়েরা জানান পারিবারিক বাধা, বাচ্চাদের পড়াশোনার চাপ বা অনেক সময় ধর্মীয় কারণে তাঁরা আর মেয়েকে নাচ শেখাতে চাইছেন না। আমরা তো নাচ করেও পড়াশোনা করেছি। নাচ মন ভালো রাখে। মানসিক প্রশান্তির জন্যই বাচ্চাদের নাচ শেখানো প্রয়োজন।’