পুরুষের প্রতি পক্ষপাত ৯৯% মানুষের

প্রতিবেদনে জেন্ডারভিত্তিক সামাজিক আচরণ নির্ণয়ে রাজনীতি, শিক্ষা, অর্থনীতি ও নারীর শারীরিক-মানসিক অধিকার—চারটি সূচক ব্যবহার করা হয়।

ইউএনডিপির লোগো

রাজনীতি, শিক্ষা, অর্থনীতি ও নারীর শারীরিক–মানসিক অধিকার—এই চারটি ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন মানুষের আচরণ পুরুষের প্রতি পক্ষপাতমূলক। অর্থাৎ এই চারটি সূচকের অন্তত একটিতে ৯০ শতাংশ নারী–পুরুষ সামাজিক আচরণে পুরুষের প্রতি পক্ষপাত করে থাকে। বাংলাদেশে এই হার আরও বেশি। দেশে ৯৯ শতাংশের বেশি মানুষ অন্তত একটি সূচকে পুরুষের প্রতি পক্ষপাত করে থাকেন। বাংলাদেশে শুধু শিক্ষায় নারী–পুরুষ সমতায় বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।

গতকাল সোমবার জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) প্রকাশিত ‘জেন্ডারভিত্তিক সামাজিক আচরণ সূচক’ (জিএসএনআই) শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এবারের প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘ব্রেকিং ডাউন জেন্ডার বায়াসেস, শিফটিং সোশ্যাল নর্মস টুওয়ার্ডস জেন্ডার ইকুয়েলিটি’ (পক্ষপাত ভেঙে জেন্ডারসমতার দিকে সামাজিক আচরণ বদল)।

প্রতিবেদনে জেন্ডারভিত্তিক সামাজিক আচরণ নির্ণয়ে চারটি সূচক ব্যবহার করা হয়ছে। এগুলো হচ্ছে রাজনীতি, শিক্ষা, অর্থনীতি, নারীর চলাচল বাধামুক্ত থাকাসহ শারীরিক ও মানসিক অধিকার (ফিজিক্যাল ইন্টেগ্রিটি)। এতে সামাজিক আচরণের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয়েছে, বিশ্বের ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ মনে করেন, স্বামী তাঁর স্ত্রীকে মারধর করতে পারেন। এই সামাজিক আচরণ একজন নারীর সামাজিক ও শারীরিক বিষয়ে পুরুষের নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সমর্থন দিচ্ছে। এই মনোভাব স্বামীর মাধ্যমে স্ত্রীর প্রতি যৌন নির্যাতনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ৮৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী এই জরিপের আওতাভুক্ত হয়েছে। ৮০টি দেশ ও অঞ্চলের চারটি সূচকের ওপর ২০১০ থেকে ২০১৪ এবং ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের উপাত্ত। ‘ওয়ার্ল্ড ভ্যালুস সার্ভে’ থেকে বিভিন্ন দেশের উপাত্ত নেওয়া হয়েছে।

সামাজিক আচরণ সূচক ও বৈশ্বিক অবস্থা

রাজনীতির ক্ষেত্রে সূচকে ছিল—গণতন্ত্রে পুরুষের সমান অধিকার থাকা উচিত নারীর এবং নারীর চেয়ে পুরুষ ভালো রাজনৈতিক নেতা হয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে ছিল—বিশ্ববিদ্যালয় নারীর চেয়ে পুরুষের জন্য বেশি জরুরি। অর্থনৈতিক সূচকে ছিল—নারীর চেয়ে পুরুষের চাকরি করার অধিকার বেশি এবং ব্যবসায় নারীর চেয়ে পুরুষ ভালো নির্বাহী হয়। শারীরিক ও মানসিক অধিকারের ক্ষেত্রে সূচকে ছিল—সঙ্গীকে নির্যাতন করার কর্তৃত্ব ও প্রজনন অধিকারের বিষয়ে কর্তৃত্ব। এই সূচকগুলোর ওপর মতামত নেওয়া হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনীতিতে জেন্ডার অসমতা এখনো অনেক বেশি। ১৯৯৫ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান নারী হওয়ার হার মাত্র ১০ শতাংশ। পার্লামেন্টে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ২৫ শতাংশ। পুরুষ রাজনীতিবিদের চেয়ে নারী রাজনীতিবিদের প্রতি সমাজে বিরূপ মনোভাব পোষণ করা হয়। রাজনীতিতে ৬১ শতাংশ মানুষের পুরুষের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ রয়েছে। এর মধ্যে গণতন্ত্রে নারী–পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস করে মাত্র ২৭ শতাংশ, ৪৯ শতাংশ মানুষ মনে করে নারীর চেয়ে পুরুষেরা ভালো নেতা হয়।

এতে বলা হয়, ২৮ শতাংশ মানুষ মনে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পুরুষের বেশি জরুরি। অর্থনীতিতে পুরুষের প্রতি পক্ষপাত রয়েছে ৬০ শতাংশ মানুষের। এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ মানুষ মনে করে, চাকরিতে পুরুষের অধিকার বেশি। ৪৩ শতাংশের বিশ্বাস, ব্যবসায় নির্বাহী পদে নারীর চেয়ে পুরুষ বেশি ভালো। নারীর শারীরিক ও মানসিক অধিকারের ক্ষেত্রে পুরুষের কর্তৃত্বে বিশ্বাসী ৭৫ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে ৫৮ শতাংশ মনে করে, প্রজনন অধিকারে পুরুষের কর্তৃত্ব থাকা উচিত। আর ২৫ শতাংশ মনে করে সঙ্গীকে মারধর করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ শিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম পক্ষপাতদুষ্ট

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে চার সূচকের মধ্যে অন্তত একটি সূচকে পুরুষের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ রয়েছে ৯৯ শতাংশের বেশি নারী–পুরুষের। অন্তত দুটি সূচকে পক্ষপাতমূলক আচরণ রয়েছে প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষের।

চারটি সূচক আলাদা করে বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষার ক্ষেত্রে কম পক্ষপাতদুষ্ট। এ ক্ষেত্রে ৪৪ শতাংশের বেশি মানুষ পক্ষপাতমূলক আচরণ করে। রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রায় ৬৯ শতাংশ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ৮৮ শতাংশ এবং নারীর ওপর কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে প্রায় ৮৮ শতাংশের পুরুষের প্রতি পক্ষপাতমূলক মনোভাব রয়েছে।

বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশের ৯৯ শতাংশের বেশি মানুষের অন্তত একটি ক্ষেত্রে জেন্ডারভিত্তিক সামাজিক আচরণ পক্ষপাতদুষ্ট। বাকি ১২টি দেশ হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কাতার, তাজিকিস্তান, ফিলিপাইন, লিবিয়া, মালি, রুয়ান্ডা ও নাইজেরিয়া।

আরও পড়ুন

অন্তত একটি ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম পক্ষপাতমূলক আচরণ করার দেশ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। দেশটির প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষের পক্ষপাতমূলক আচরণ রয়েছে। এরপরের অবস্থানে রয়েছে নরওয়ে (প্রায় ৪১ শতাংশ) এবং ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে অবস্থিত ছোট ইউরোপীয় দেশ অ্যান্ডোরা (৪২ শতাংশ)।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরণের পক্ষপাতমূলক সামাজিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুসারে জেন্ডারসমতা অর্জন করা সম্ভব হবে না। এ ধরনের আচরণ জেন্ডারসমতা অর্জন ও নারীর ক্ষমতায়নের পথে প্রধান বাধা। এসব আচরণ নারীর সক্ষমতা ও সামাজিক অধিকারের বিষয়কে মূল্যায়ন করে না। নারীর প্রত্যাশার জায়গাটিকে বাধাগ্রস্ত করা হয় ও সুযোগগুলোকে সীমিত করে ফেলা হয়।

মনোভাব বদলাতে শক্তিশালী আন্দোলন প্রয়োজন

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম প্রথম আলোকে বলেন, নারীরা যত অধিকার সচেতন হচ্ছে, সমাজের তত পুরুষের পক্ষে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নারীর অধিকার পরিবারেও স্বীকৃত হয় না। এ অবস্থা পরিবর্তনে সব স্তরের নারী–পুরুষের একসঙ্গে শক্তিশালী আন্দোলন করতে হবে। নারীর সমতা অর্জনে যা যা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দূর করতে ব্যবস্থা নিতে হবে রাষ্ট্রকে।

ইউএনডিপির এই বৈশ্বিক প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মনোয়ারা ইশরাতের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, প্রতিবেদনটি তিনি এখনো দেখেননি। তিনি পড়ার আগে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না।