বাড়ছে কিউলেক্স মশা, নতুন ঝুঁকির শঙ্কা

ডেঙ্গুবাহী মশা বা এডিস মশার গায়ে ডোরাকাটা থাকে

কিউলেক্স মশার কামড়ে ফাইলেরিয়া বা গোদরোগের পাশাপাশি চর্মরোগের ঝুঁকি রয়েছে। রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে এ মশার উপদ্রব। একটি গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে।

তীব্র শীতের মধ্যেও কিউলেক্স মশা বৃদ্ধির যে হার, তাতে শীত কমলে তা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা কীটতত্ত্ববিদদের। এ অবস্থায় রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনই মশা নিয়ন্ত্রণে নানা পরিকল্পনার কথা বলছে। তবে তাদের উদ্যোগ পর্যাপ্ত ও যথাযথ নয় বলে মনে করছেন গবেষকেরা।

কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, দেশে মোটামুটিভাবে ১২৩ প্রজাতির মশা আছে। এর মধ্যে ১৬ প্রজাতির মশা বেশি দেখা যায়। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বছরজুড়ে যে কয়েক প্রজাতির মশা থাকে, এর মধ্যে কিউলেক্সই ৯৫ শতাংশের বেশি।

দেশে কিউলেক্স মশার প্রভাব দেখা দেয় অক্টোবর থেকে। অবশ্য শীতের তীব্রতা বাড়লে মশার কামড়ের মাত্রা কমে। তবে ফেব্রুয়ারি থেকেই কিউলেক্সের দাপট বাড়ে। এপ্রিলে কালবৈশাখীর কারণে অনেক স্থানে এ মশা কমে আসে।

গবেষণা ফলাফল ধারণা দেয়, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব অনেক বেশি হবে। তাই এখনই মশা নিধনে নর্দমা, ডোবা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সেখানে লার্ভা মারার জন্য কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
কবিরুল বাশার, কীটতত্ত্ববিদ

গত বছরের অক্টোবর থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির যাত্রাবাড়ী, উত্তর সিটির দক্ষিণখান, উত্তরার দুটি স্থান ও মিরপুর এবং ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মশা পর্যবেক্ষণ করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একটি গবেষক দল। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন ওই বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার।

মশার ফাঁদ পেতে এই গবেষণা চালানো হচ্ছে। অক্টোবর মাসে গবেষণার শুরুতে সপ্তাহে গড়ে কমবেশি ২০০টি করে মশা ধরা পড়ত সব ফাঁদে। নভেম্বর মাসেও গড় সংখ্যা মোটামুটি একই থাকে। তবে ডিসেম্বর থেকে এ সংখ্যা ২৫০ হয়ে যায়। চলতি জানুয়ারি মাসে এ সংখ্যা ৩০০টিতে ঠেকেছে।

কবিরুল বাশার বলেন, ‘এই গবেষণা ফলাফল ধারণা দেয়, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব অনেক বেশি হবে। তাই এখনই মশা নিধনে নর্দমা, ডোবা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সেখানে লার্ভা মারার জন্য কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।’

গবেষণায় দেখা যায়, রাজধানীর চার এলাকার পাঁচ স্থানের মধ্যে উত্তরায় মশা সবচেয়ে বেশি। চলতি জানুয়ারি মাসের শুরুতে সেখানে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৪০০ মশা ফাঁদে ধরা পড়েছে। মশার এত সংখ্যা নগরের কোথাও দেখা যায়নি। এরপর আছে মিরপুর ও দক্ষিণখান। যাত্রাবাড়ীতে অপেক্ষাকৃত কম হলেও এখন ডিসেম্বরের চেয়ে গড়ে ৫০টি মশা বেশি ধরা পড়ছে।

উত্তরা ১৩ নম্বরের ৫ নম্বর সড়কের বাসিন্দা সাজেদুল ইসলাম। গত শুক্রবার তিনি বলেন, ‘বাড়ির দরজার সামনে সন্ধ্যার পর থেকেই কয়েল দিয়ে রাখি। সন্ধ্যার পর দরজা খুললে দলে দলে মশা ঢুকে পড়ে। সন্ধ্যার পর থেকেই বাড়তে থাকে মশা।’

যা বলছে দুই সিটি কর্তৃপক্ষ

কিউলেক্স মশার কামড়ে ফাইলেরিয়া বা গোদরোগ ও জাপানি এনসেফালাইটিস হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দুটি রোগ বাংলাদেশে প্রকট নয়। কিউলেক্সের বড় সমস্যা এরা সংখ্যায় বিপুল ও ব্যক্তির জন্য উৎপাতকারী।

অবশ্য এই মশার কামড়ে অনেকের প্রুরিগো সিমপ্লেক্স নামের অ্যালার্জিজনিত অসুখ হয় বলে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের চিকিৎসক রাশেদ মোহাম্মাদ খান। তিনি বলেন, এ অসুখই বেশি পরিমাণে দেখা দেয়, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারির পর থেকে। মশার কামড়ের জায়গায় ময়লা নখের আঁচড়ে এ রোগ হয়। এতে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি।

কিউলেক্স মশা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রস্তুতি প্রসঙ্গে সংস্থাটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিউলেক্স মশা যে আগামী মাসে বেড়ে যেতে পারে, তা আমরাও মনে করছি। মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে পাঁচ কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখন মশা নিধনে যেসব ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে বা যেসব কর্মসূচি আছে, সেগুলোর কার্যকারিতা নতুন করে দেখা হচ্ছে।’

আর ঢাকা দক্ষিণ সিটির (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামস কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘দক্ষিণে কিউলেক্স যে নেই তা বলব না। তবে আমাদের এখানে নিয়ন্ত্রণে আছে। দক্ষিণ সিটিতে কিউলেক্স দমনে টেমিফস এবং এর পাশাপাশি ম্যালাথিয়ন ও ডেল্টামেথ্রিনের মিশ্রণ ব্যবহার করা হচ্ছে।’

তবে দুই সিটির মশা নিধনের উদ্যোগ নিয়ে নানা সমালোচনা আছে। গত বছর এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুতে দুই সিটিতে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা ২২ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এ বছর কিউলেক্সও ব্যাপক হারে বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ঢাকার মশার অবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন কীটতত্ত্ববিদ মনজুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ৩০ বছরে ঢাকার মশা নিধনে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। লার্ভা নিধন, প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ এবং নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগ—এ তিন বিষয় মশা নিধনে জরুরি। এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, মশার ওষুধের কার্যকর প্রয়োগ হয় না। আর যেসব ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো কতটুকু কার্যকর, তা–ও নিয়মিত দেখা হয় না। বর্তমানে ব্যাসিলাস স্ফেরিকাস নামের একটি ওষুধ খুবই কার্যকর বলে বিবেচিত হচ্ছে। এর ব্যাপারে দুই সিটির কারও আগ্রহ নেই।