যন্ত্রণায় কথা বলতে পারছিলেন না মধ্যবয়সী নারীটি

নারী নির্যাতন
প্রতীকী ছবি

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে মঙ্গলবার দুপুরে এক নারীকে (৪৫) ধরে নিয়ে এলেন কয়েকজন। পাশের দুজনের কাঁধে হাত দিয়েও নিজের ভর রাখতে পারছিলেন না তিনি। টিকিট কেটে দ্রুত তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসকের কাছে। তখনো ঠোঁট থেকে ওই নারীর রক্ত ঝরছে। বন্ধ চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে ক্রমাগত। ব্যথায় কোঁকাচ্ছিলেন তিনি। সঙ্গে মা, এক মেয়ে আর ভাই এসেছেন। মঙ্গলবার সকালে স্বামী মেরেছেন আলেয়া বেগমকে (ছদ্ম নাম)। আলেয়ার পরিবার জানাল, বুকে–পিঠে এলোপাতাড়ি লাথি মারার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। মারধরের পর তাঁকে মেঝেতে শুইয়ে রাখেন স্বামীর বাড়ির লোকজন। আলেয়ার সঙ্গে থাকা তাঁর মা নিজের মেয়ের কাপড় দেখিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলেন মেয়ে কতটা রক্তাক্ত হয়েছে। চিকিৎসক আলেয়াকে দেখে জরুরিভাবে কিছু পরীক্ষা করাতে নির্দেশ দিলেন।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক উম্মে হাবিবা মঙ্গলবার দুপুরে প্রথম দেখেন আলেয়া বেগমকে। এর পরপরই চিকিৎসকের কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘ঠোঁট ফেটেছে। রোগীর হিস্ট্রি বলছে, আগেও কয়েকবার তিনি মার খেয়েছেন। তলপেটে তীব্র ব্যথা আছে। ভেতরে কোনো রক্তক্ষরণ হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে আলট্রাসাউন্ডের রিপোর্ট দরকার। এ জন্য পরীক্ষা করাতে বলেছি। আপাতত ব্যথা কমার ওষুধ দেওয়া হয়েছে।’

সরকারি ছুটির দিনে হাসপাতালের পরীক্ষাগার বন্ধ বলে আলেয়াকে নিয়ে যেতে হবে কোনো প্রাইভেট ক্লিনিকে। কিন্তু তাঁকে হাসপাতালের বেঞ্চ থেকে তুলতে পারছিলেন না পরিবারের সদস্যরা। অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আলেয়ার ষাটোর্ধ্ব মা জানালেন, সিএনজি অটোরিকশাচালক সবুজ মিয়ার (ছদ্ম নাম) সঙ্গে আলেয়া বেগমের বিয়ে হয় এক বছর আগে। বিয়ের দেনমোহর নির্ধারণ হয়েছিল দুই লাখ টাকা। সবুজ কথায় কথায় আলেয়াকে ফেরত পাঠাতে চান। আবার ঘরের জিনিসপত্র, নগদ টাকাপয়সা দাবি করে মারধর করেন।

দুজনেরই এটা দ্বিতীয় বিয়ে। আগের ঘরে আলেয়ার দুই মেয়ে আছে। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে পোশাকশ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন আলেয়া। মেয়েদের বড় করে দুই মেয়েকেই বিয়ে দিয়েছেন তিনি। আলেয়ার গ্রামের বাড়ি ভোলার লালমোহনে। তবে তাঁর মা ও ভাইয়েরা থাকেন রাজধানীর শনির আখড়ায়। নির্যাতনে প্রায় অচেতন হয়ে যাওয়া আলেয়ার সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছোট ভাই মিনহাজুল আলম (ছদ্ম নাম)। তিনি কাজ করেন রাজধানীর একটি আসবাব তৈরির দোকানে। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমার বোনরে এত মারছে যে সে জ্ঞান হারায় ফেলছে। আশপাশের মানুষ ফোনে খবর দিছে। এই ব্যাটার লগে এক বছর আগে সংসার শুরুর পর অন্তত ২০ বার বোনরে মারছে। কিন্তু প্রতিবার সুস্থ হইলে বোন আবার ফিরা যায় সংসারে। কয়, এই বয়সে মাইনসে কী কইব! গত বছর এ রকম ঘটনার পর আমি নিজে যাত্রাবাড়ী থানায় জিডি করছি।’

আলেয়ার দ্বিতীয় স্বামী অটোরিকশাচালক সবুজ মিয়ার প্রথম স্ত্রী মারা যান করোনার শুরুতে। তাঁর দুই ছেলেই এখন যুবক। তাঁরা বাবার সঙ্গে একই বাড়িতে থাকেন রাজধানীর দোলাইপাড়ে। এক আত্মীয়ের মাধ্যমে গত বছর বিয়ে হয় আলেয়া ও সবুজের। তবে আলেয়ার পরিবারের সব অভিযোগ অস্বীকার করলেন আলেয়ার স্বামী। মঙ্গলবার বিকেলে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুজনের মধ্যে কথা–কাটাকাটি হইলে অনেক কিছু ঘটে। ধাক্কাটা একটু বেশি জোরে দিয়া ফেলছি। তখন ঠোঁট কাইটা যায়। আমি তো সঙ্গে সঙ্গে মাফ চাইয়া বলছি, চল ডাক্তারের কাছে নিয়া যাই। বাকি সব অভিযোগ বানানো কথা।’

মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নির্যাতিত আলেয়াকে চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের করার পর দীর্ঘ সময় বসিয়ে রাখা হয়েছিল বেঞ্চে। কোনোভাবেই উঠে দাঁড়ানোর শক্তি ছিল না তাঁর। কথাও বলতে পারছিলেন না। তবুও নির্দয়ের মতো তাঁর কাছে গিয়ে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, কী হয়েছে আপনার? আলেয়া বেগম কোনোমতে উত্তর দিলেন, ‘অনেক মারছে আমারে। খুব কষ্ট হইতেছে। আর কথা কইতে পারতিছি না।’

আজ বুধবার দুপুরে আলেয়ার মায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘মেয়ের অনেক জ্বর গতকাল থেকে। জ্বরের ঘোরে সে আবোলতাবোল বকছে। পানিও মুখে নিতে পারছে না। তাই পরীক্ষা করাতে নেওয়া সম্ভব হয় নাই। আমি একা মানুষ কিছু করতেও পারছি না।’

আলেয়া বেগমের ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বোনের স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। তবে আগে বোনের সুস্থ হওয়া জরুরি।

সমাজের সব স্তরের নারীই আলেয়া বেগমের মতো পরিস্থিতির শিকার হয়ে থাকেন বলে মনে করেন পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট ‘আমরাই পারি’র প্রধান জিনাত আরা হক। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য ভুক্তভোগীকেই প্রথম সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়াটা জরুরি। কিন্তু এদেশে এসব কারণে বেশির ভাগ এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন, যেমনটা এই নারীর ক্ষেত্রেও ঘটছে।