শূন্য হাতে ফিরছেন লাখো প্রবাসী

শুধু আউট পাস নিয়ে এ বছর ফিরেছেন ৮০ হাজারের বেশি। বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফেরার টাকাটাও থাকে না তাঁদের হাতে।

প্রবাসী শ্রমিক
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

দুই বছর ধরে প্রতি মাসে গড়ে লাখের বেশি নতুন কর্মী যাচ্ছেন বিভিন্ন দেশে। তাঁদের অনেকেই গিয়ে কাজ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ আছে। তাই বিপুল কর্মসংস্থানের স্রোতের মধ্যেই ব্যর্থ হয়ে ফিরছেন অনেক প্রবাসী। তাঁদের কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। সব হারিয়ে, পুলিশের হাতে আটক হয়ে, একদম বাধ্য হয়ে, শূন্য হাতে যাঁরা ফিরে আসেন; হিসাব আছে শুধু তাঁদের।

নিঃস্ব এমন প্রবাসীদের হাতে পাসপোর্ট থাকে না। দেশে ফেরার জন্য দূতাবাস থেকে তাঁদের একটি আউট পাস (ভ্রমণের বৈধ অনুমতিপত্র) সরবরাহ করা হয়। আউট পাস নিয়ে দেশে ফেরা প্রবাসীদের তথ্য সংগ্রহ করে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পক্ষ থেকে বিমানবন্দরে প্রবাসীদের বিভিন্ন সেবা দিতে এ ডেস্ক কাজ করে।

অসফল হয়ে ফিরে আসা মোট প্রবাসীর সংখ্যা আউট পাস নিয়ে ফেরা সংখ্যার চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি হওয়ার কথা। এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির দিক আছে। তাই এটা প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।
শাকিরুল ইসলাম, চেয়ারপারসন, ওকাপ

ঋণ করে দালালের মাধ্যমে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ওমান গিয়েছিলেন টাঙ্গাইলের মো. আবদুল বাসেত। হোটেলে কাজ করার কথা থাকলেও তা পাননি। পরে একটি সাপ্লাই কোম্পানিতে নিয়ে যায় দালাল। সেখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় বাদ পড়েন তিনি। এরপর মরুভূমিতে দালালের এক আস্তানায় ১৩ দিন আটকে ছিলেন খাবারের কষ্ট নিয়ে। বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে আসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, খালি হাতে দেশে ফিরলে ভিক্ষা করতে হবে। তাই অনেক অনুরোধ করেছেন, কিন্তু কাজ পাননি। দেশ থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেই গেছেন। এখন পাঁচ লাখ টাকা ঋণের দায় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

কয়েক লাখ টাকা খরচ করে পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে বিদেশে গেছেন। নির্ধারিত সময়ের আগেই ঋণগ্রস্ত হয়ে ফিরে এসেছেন দেশে। এমন প্রবাসীরা বলছেন, সৌদি আরবে প্রচুর কর্মী যাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত কাজ নেই। তাই গিয়ে বেকার জীবন যাপন করতে হচ্ছে। শুধু সৌদি নয়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরা কর্মীদের মধ্যে কারও ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

কারও কারও ইকামা (কাজের বৈধ অনুমতিপত্র) নেই। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের মনির মিয়া ফিরেছেন এ মাসের শুরুতে। কৃষিকাজ করতে সৌদি যান। এর পাশাপাশি অন্য কাজের সুযোগ দেওয়ার কথা ছিল। সুযোগ না পেয়ে খামার থেকে পালিয়ে যান আট মাস পর। এরপর দুই বছর অবৈধভাবে বিভিন্ন জায়গায় ছিলেন। শেষ ছয় মাস কোনো কাজ ছিল না। বাধ্য হয়ে নিজে থেকেই দূতাবাসের সহায়তায় ফিরে এসেছেন।

দেশে ফেরত প্রবাসী কর্মীদের সেবা দিতে বিমানবন্দরে কাজ করা একাধিক সংস্থার সূত্র বলছে, কয়েক মাস ধরে দিনে ২৫০ থেকে ৩০০ জন করে প্রবাসী ফিরে আসছেন খালি হাতে। তাঁদের জামাকাপড় ঠিক নেই, পকেটে টাকা নেই।

এমন পরিস্থিতিতে আজ ১৮ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। প্রবাসী কর্মীর ভূমিকা ও তাঁদের অধিকারকে সম্মানিত করার বিষয়টিতে এবার গুরুত্ব দিয়েছে জাতিসংঘ।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির আওতায় বাড়ি ফেরার জন্য এক হাজার টাকা করে যাতায়াত খরচ দেওয়া হয়। সরকারি সংস্থার তথ্য বলছে, এ বছরের প্রথম ১১ মাসেই দেশে ফিরে এসেছেন ৭৮ হাজার ৩২৮ প্রবাসী। তবে এর বাইরে যাঁরা পাসপোর্ট নিয়ে ফিরে আসছেন, তাঁদের কোনো হিসাব নেই এ সংস্থার কাছে। তবে অভিবাসন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যর্থ অভিবাসনের প্রকৃত চিত্র আরও নাজুক। বছরে এটি লাখের অনেক বেশি হবে।

এমন পরিস্থিতিতে আজ ১৮ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। প্রবাসী কর্মীর ভূমিকা ও তাঁদের অধিকারকে সম্মানিত করার বিষয়টিতে এবার গুরুত্ব দিয়েছে জাতিসংঘ। দেশেও এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে; ‘প্রবাসী কর্মীরা উন্নয়নের অংশীদার, সমুন্নত রাখব তাঁদের অধিকার’।

ফিরে আসা বাড়ছে

২০১৯ সালে আউট পাস নিয়ে দেশে ফিরে আসেন ৬৪ হাজার ৪৩৮ জন। এরপর ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরুর পর প্রবাসীরা দেশে ফিরতে শুরু করেন। ওই সময় দেশে ফেরা সব প্রবাসীর হিসাব রাখতে শুরু করে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক। এতে বছরে প্রায় চার লাখ প্রবাসী কর্মীর তথ্য পাওয়া যায়। যদিও তাঁদের মধ্যে একটি বড় অংশ ছুটিতে দেশে আসেন, যাঁদের অধিকাংশই আবার ফিরে গেছেন। তবে এখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা প্রবাসীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য বলছে, এ বছরের ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত শূন্য হাতে দেশে ফিরে এসেছেন ৮০ হাজার ৮১১ জন প্রবাসী। এর মধ্যে পুরুষ কর্মী ৭৮ হাজার ৭৯ জন ও নারী কর্মী ২ হাজার ৭৩২ জন। তবে এটি আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সৌদি আরবে নিয়মিত অভিযান চলছে। নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়ায় কর্মীদের দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। একই কাজ করছে মালয়েশিয়াসহ অন্য আরও কিছু দেশ। সরকারি তথ্য বলছে, গত অক্টোবরে দেশে ফিরেছেন ৬ হাজার ৪৯৩ জন। আর নভেম্বরে দেশে ফিরেছেন ৮ হাজার ৪৫২ জন।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন প্রথম আলোকে বলেন, একজন কর্মীও বিদেশে গিয়ে যাতে প্রতারিত হয়ে ফিরে না আসেন, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। তাই কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া আগের চেয়ে কঠিন করা হয়েছে। পাঠানোর আগেই কর্মীর চাকরির নিশ্চয়তা যাচাই করে তা নিশ্চিত করতে কাজ করা হচ্ছে।

দেশে ফিরে অসহায় প্রবাসীরা

বিদেশে কর্মী পাঠানো নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগ আছে। তবে ফিরে আসা কর্মীদের নিয়ে তেমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই। ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন অনেক দেশ আগে থেকে এটি শুরু করেছে। করোনার পর দেশে কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। যদিও এর মাধ্যমে সুফলভোগীর সংখ্যা খুব একটা বাড়েনি। ঋণগ্রস্ত হয়ে ফিরে আসা কর্মীরা দেশে ফিরে আরও বিপদে পড়ে যান। পরিবার অসহায় হয়ে যায়। তাঁদের পুনরায় কাজের ব্যবস্থা করাটা জরুরি। শুধু সরকারের কাজ নয় এটি, সবার এদিকে মনোযোগ দিতে হবে।

নভেম্বরের শেষে দেশে ফিরেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের শামীম মিয়া। সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরব গিয়েছিলেন নির্মাণশ্রমিক হিসেবে। কর্মস্থল থেকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। এক সপ্তাহ রেখে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তিনি বলেন, ইকামার মেয়াদ ছিল দুই মাস। তারপরও পুলিশ পাঠিয়ে দিয়েছে। মাত্র আট মাস থেকেছেন সৌদি। ঋণের টাকা শোধ করতে পারেননি। পাঁচজনের সংসার নিয়ে এখন দেনার জীবন কাটাচ্ছেন। তিনি আরও ২২৭ জনকে আটক হতে দেখেছেন সৌদিতে।

এক মাসের মধ্যেও ফিরছেন কেউ কেউ

গত ২ মার্চ দালালের মাধ্যমে সৌদি আরব যান ঢাকার আশিস মণ্ডল। একসঙ্গে গিয়েছিলেন ১৮ জন। যথাযথ কাগজ না থাকায় দাম্মাম বিমানবন্দরে দুজনকে আটকে দেওয়া হয়। তিন দিন সেখানে রেখে ফেরত পাঠানো হয় দেশে। বাড়ি ফিরে ১৫ হাজার টাকা এনে বিমানকে পরিশোধ করার পর পাসপোর্ট ফেরত পান আশিস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে খালি হাতে ফিরেছেন। এখন ধারদেনায় জর্জরিত পরিবার। দালালের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। এভাবে বিদেশে পাঠালে তো ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকবে না।

২০২০ সালের পর বিদেশে গিয়ে ফিরে আসা ২১৮ জন কর্মীর ওপর জরিপ চালিয়েছে অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রামরু। এর মধ্যে ৪২ জন নারী কর্মী রয়েছে। গত অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে এ জরিপ চালায় তারা। নানা কারণে কর্মীরা দেশে ফিরে এসেছেন বলে জানিয়েছে রামরুর প্রতিবেদন। গত মাসে এটি প্রকাশ করেছে তারা।

রামরুর প্রতিবেদন বলছে, কাজ না পেয়ে ফিরে এসেছে একটি বড় অংশ। এর মধ্যে বিদেশে গিয়ে কোনো কাজ পাননি ১৫ শতাংশ কর্মী। আর ২০ শতাংশ তাঁদের চুক্তি অনুসারে কাজ পাননি। এসব ক্ষেত্রে কর্মীদের দেশে ফিরে আসা ছাড়া উপায় থাকে না। বিদেশে যাওয়ার এক মাসের মধ্যে জরিপে অংশ নেওয়া কর্মীদের ১৫ শতাংশ ফিরে এসেছেন। আর ৬ মাসের মধ্যে দেশে ফিরেছেন ২৯ শতাংশ।

এ ছাড়া যাঁরা আটক হয়ে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের ৪৭ শতাংশের ইকামা ছিল না। আগে ফিরে আসায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দেশে ফিরে ৭২ শতাংশ কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। এর মধ্যে অনেকেই ফিরে এসে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছেন।

তৃণমূল পর্যায়ে অভিবাসীদের সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আউট পাস নিয়ে যাঁরা ফেরেন, তাঁরা সর্বস্বান্ত হয়ে, আটক হয়ে ফেরেন। এর বাইরে অসুস্থ হয়ে, কাজ না পেয়ে, স্বেচ্ছায় অনেকে ফিরে আসেন। তাঁদের সংখ্যা কারও জানা নেই। তাই অসফল হয়ে ফিরে আসা মোট প্রবাসীর সংখ্যা আউট পাস নিয়ে ফেরা সংখ্যার চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি হওয়ার কথা। এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির দিক আছে। তাই এটা প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।