বাবার চাকরির সূত্রে আমার ছোটবেলার বড় অংশ কেটেছে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন অঞ্চলে। সে সময় চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখ মাসে মেলা হতো। এসব মেলায় মাটির বানানো নানা ধরনের পুতুল, নকশা করা হাতপাখা পাওয়া যেত। সময়টা গরমের। তাই হাতপাখার বেশ চল ছিল। আর মেলায় দেখতাম নাগরদোলা। বৈশাখ মাসজুড়ে নানা মেলা হতো। তবে এখন পয়লা বৈশাখে পান্তা খাওয়ার যে রীতি, তা কোথাও কখনো দেখিনি বা শুনিনি। এর সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার বিষয়টিও এমন। আমি একসময় টোকাই কার্টুনে লিখেছিলাম, ‘আমার তো রোজই বৈশাখ, রোজই পান্তা খাই।’ পয়লা বৈশাখে ইলিশ-পান্তা, এটা শহুরে আবিষ্কার। আর এটা হয়েছে অনেক পরে।
আমাদের পরিবার ১৯৫২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করে। আমরা থাকতাম পুরান ঢাকায়। পড়তাম পোগোজ স্কুলে। বৈশাখে নানা অনুষ্ঠান সে সময় হতো। যতটুকু মনে পড়ে, তখন তিনটি মেলা হতো। সেগুলো হলো বৈশাখী মেলা, মহররমের মেলা ও ঈদের মেলা। পবিত্র রমজানের ঈদের পরদিন ঈদের মেলাটি হতো গেন্ডারিয়ার লোহার পুলের কাছে। আর আরমানিটোলায় বৈশাখী মেলা বসত। সে সময়টায় বাবার সঙ্গে মেলায় যেতাম। বৈশাখী মেলায় গ্রামের লোকশিল্পের যত পসরা, তা আনা হতো। এসব আনতেন ঢাকার আশপাশের কারিগরেরা। ঢাকার আশপাশের নবাবগঞ্জ, দোহার, বিক্রমপুরের লৌহজংয়ের দীঘলি, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর অঞ্চলে বৈশাখ মাসে গ্রামীণ মেলা বসত। ঢাকার আশপাশের এসব অঞ্চলে চড়কের মেলাও বসত বলে শুনেছি। চৈত্রসংক্রান্তিতে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা হালখাতার আয়োজন করতেন। বছরের সব হিসাব-নিকাশ সেদিন শেষ করা হতো। লম্বা কাপড় জড়ানো খাতায় নতুন বছরের হিসাব শুরু হতো। হিন্দু-মুসলিম উভয় ব্যবসায়ীই হালখাতার আয়োজন করতেন। আর সঙ্গে ছিল মিষ্টিমুখের আয়োজন।
এই বৈশাখ মাসেই তৎকালীন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা লোকশিল্প মেলার আয়োজন করত। শিল্পী কামরুল হাসান, ইমদাদ হোসেন এসব মেলায় নানা কারুশিল্প তুলে ধরতেন। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার ডিজাইন সেন্টারের প্রধান ছিলেন কামরুল হাসান। শুধু বৈশাখ মাসে নয়, বছরের নানা সময় বিভিন্ন উপলক্ষে মেলা হতো। তাতে জামদানি, মসলিন ও রেশমের পসরা থাকত। কামরুল হাসান পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বড় মেলার আয়োজন করতেন। সেখানে তৎকালীন আর্ট কলেজের শিক্ষার্থীদের নানা কাজ থাকত।
১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করল। স্বাধিকার আন্দোলনের ঢেউ তখন লেগেছে। সেই রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে মিলল জোরালো সাংস্কৃতিক আন্দোলন। পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা শুরু করল। বাঙালির যা কিছু স্বকীয়তা আছে, তার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র জোরদার করল পাকিস্তানি শাসকেরা। খাদ্যাভ্যাস, পোশাক–পরিচ্ছদ, ভাষা—কোনো কিছুতেই তো ওদের সঙ্গে আমাদের মিল ছিল না। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সবকিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা তখন নিরন্তর। আমরা কী, আমাদের শিকড় কোথায়—এসব প্রশ্ন বাঙালি সমাজকে আরও একত্র করতে থাকল। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আন্দোলন শুরু হলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, তাসের দেশ নৃত্যনাট্যগুলো বেশি বেশি করে মঞ্চায়ন শুরু হলো। তখন আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। একে ঘিরে নানা আয়োজন। তবে একুশে ফেব্রুয়ারি নয়, বছরে কোনো উপলক্ষ পেলেই সেখানে এসব প্রদর্শিত হতো। আমরা এসব বিষয়ে যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। কোনো কর্তব্যপালনের বোধ থেকে কিন্তু নয়। এ একধরনের অদ্ভুত অনুভব। আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসবের সঙ্গে যুক্ত থাকতাম। আমি চিত্রাঙ্গদা ও মায়ার খেলা নৃত্যনাট্যের এবং বিসর্জন নাটকের কস্টিউম ডিজাইন ও সেট ডিজাইনের কাজ করেছিলাম। এ সময় রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ নাটকের পরিচালনা থেকে শুরু করে সেট ডিজাইনের কাজ করেছেন মুস্তাফা মনোয়ার।
এই ষাটের দশকের শুরুর দিকে গঠিত হলো ছায়ানট। বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি প্রবল বৈরী পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন তখন এক নতুন প্রাণ পেল। আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ছায়ানট প্রতিষ্ঠা বিশাল এক ঘটনা। আর ছায়ানট যখন রমনার বটমূলে বৈশাখের প্রভাতে সংগীত আয়োজন শুরু করে, তখন অভাবনীয় এক সাড়া পড়ে গেল। মানুষ সারা বছর এই দিনটির জন্য বসে থাকত, এ বছর ছায়ানট আবার কী কী নতুন গান নিয়ে আসছে। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে বড় শিল্পীও হলো অনেকে। আমাদের চেতনাগত ব্যাপার বলি, আমাদের বাঙালিয়ানা সম্পর্কে সচেতনতার ক্ষেত্রে ছায়ানট তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সবচেয়ে ভালো লাগে, ছায়ানট সেই যে শুরু করেছে, তারা আজও সেই কাঠামোর মধ্যে আছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যুক্ত হয়েছে এর সঙ্গে। কিন্তু আমার মনে হয়, আমি সেই শুরুর প্রজন্মকেই বোধ হয় দেখছি। আমাদের জাতীয় জীবনে, সাংস্কৃতিক জীবনে এটা বড় মাপের বিষয়। শুরুতে পাকিস্তানিরা ছায়ানটের এই বর্ষবরণের বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। পরে যখন বুঝতে পারল, তখন প্রতিহত করার উপায় খোঁজা শুরু করল। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে।
ষাটের দশকের শেষ দিকে শিল্পীরা ‘কালবৈশাখী’ নামে একটি চিত্র প্রদর্শনী করেছিলেন। এখানে দেশের বড় সব শিল্পীর ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল। এর পেছনে একটা রাজনৈতিক ভাবনা ছিল। কালবৈশাখী শব্দটিকে প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। ছবিগুলোও ছিল বাঙালি চেতনালব্ধ।
আমাদের নববর্ষ উদ্যাপনে নতুন অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। এর শুরুটা হয়েছিল যশোরে। স্থানীয় সংগঠন চারুপীঠ আর্ট ইনস্টিটিউট আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে এটি শুরু করে। আমরা বিষয়টি দেখে উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম। ১৯৮৬ সাল থেকেই এমন শোভাযাত্রা আয়োজন নিয়ে আমাদের ভাবনা শুরু হয়। এ সময় আমি চারুশিল্পী সংসদের প্রথম সভাপতি ছিলাম। আনন্দ শোভাযাত্রা শুরুর প্রক্রিয়ায় শিল্পী কামরুল হাসান, ইমদাদ হোসেন, কাইয়ুম চৌধুরীসহ অনেকেই ছিলেন। আমাদের লক্ষ্য ছিল, বাংলার লোকজ উপাদান ব্যবহার করে আমরা এই শোভাযাত্রা করব। এটাকে বর্ণিল করব, যাতে উৎসবের রং থাকে। টেপা পুতুল, কাঁথা, কাঠের হাতি, ঘোড়া—যেসব সামগ্রী ছোট ছোট খেলনা আকারে দেখেছি, সেগুলোই বৃহৎ আকারে আমরা তুলে ধরতে চেয়েছি। সৌন্দর্যের দিকটাকে আমরা দেখেছি। আবার চেতনাগতভাবে আমরা যেন এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ অনুভব করি, সে বিষয়টিও ছিল। শুরুতে এর নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। পরে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যখন শুরু হলো, তখন আমরা মানুষের কল্যাণ কামনায় একে মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম দিলাম। আমাদের দেশের, নিজেদের মঙ্গল কামনায় এ শোভাযাত্রা শুরু হলো। কেবল আনন্দ নয়, এর মধ্যে শুভবোধের বার্তা আছে।
এখন মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেসকোর মাধ্যমে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এখন এ শোভাযাত্রা হচ্ছে। আমাদের দেখাদেখি ভারতের কলকাতাতেও শোভাযাত্রা হচ্ছে। এটা আনন্দের। তবে এই শোভাযাত্রায় যেন অশুভ কোনো কিছু প্রবেশ না করে, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। আমাদের লোকশিল্প, আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ ধরে রাখাই এ শোভাযাত্রার লক্ষ্য। চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেছে এ শোভাযাত্রা। তাই এর একটি নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। এর মধ্যে যেন বাঙালিত্বের বিরোধী উপাদান না ঢুকে যায়, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এ শোভাযাত্রা, বর্ষবরণের নানা আয়োজন বাংলার সংস্কৃতির স্বকীয়তার প্রতীক। নতুন বছরের প্রথম দিন আনন্দ করার সময়। সেই আনন্দকে আমরা একটি রূপ দিয়েছি। একটি মিছিল হয়, সেটা সুসজ্জিত থাকে। সেই সজ্জায় আমাদের নিজস্ব জিনিসগুলোকে তুলে ধরি। আমরা এ শোভাযাত্রায় লোকশিল্পের যে উপাদানগুলো ব্যবহার করি, তা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার সম্পদ। এতে সবার অংশীদারত্ব রয়েছে।
আমরা একটা নতুন বছরে প্রবেশ করছি। এই সময়টা বড় জটিল। কোভিড-১৯-এর পর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ—এসবের রেশ টানতে হচ্ছে এ দেশের মানুষকে, সেই সঙ্গে বিশ্বের সব মানুষকে। বিশ্বময় অসহিষ্ণুতার বিস্তার দেখছি আমরা। এটা বন্ধ হোক। নতুন বছর নতুন অনেক সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়। নববর্ষের বার্তা হোক সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির।
রফিকুন নবী: অধ্যাপক, চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট।