পৌরসভার বিরোধ মীমাংসা বোর্ডের এখতিয়ার ১০ লাখ টাকা করার সুপারিশ

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মসহ কয়েকটি সংগঠনের আয়োজনে বিরোধ মীমাংসা (পৌর এলাকা) বোর্ড আইন, ২০০৪ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা। বুধবার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারছবি: সাজিদ হোসেন

নগরায়ণের ফলে একদিকে দেশের পৌরসভাগুলোতে জনসংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে অপরাধ ও বিরোধও বাড়ছে। পৌরসভাগুলোতে বিরোধ মীমাংসায় পৌর বোর্ড থাকলেও আইনি দুর্বলতার কারণে তা অকার্যকর। আইন সংস্কার করে বোর্ডকে কার্যকর করা গেলে প্রচলিত আদালতে মামলাজট কমার পাশাপাশি ভোগান্তি ও হয়রানি কমবে। তবে এই বোর্ডের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে তদারকি বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে পৌর বোর্ডের বিচারিক ক্ষমতার আর্থিক এখতিয়ার।

বুধবার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘বিরোধ মীমাংসা (পৌর এলাকা) বোর্ড আইন, ২০০৪ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক সেমিনারে আলোচকেরা এসব বিষয় তুলে ধরেন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, মাদারীপুর লিগ্যাল এইড অ্যাসোসিয়েশন (এমএলএএ), মিউনিসিপ্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ম্যাব) ও দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন যৌথ উদ্যোগে সেমিনারটি আয়োজন করে।

সেমিনারের প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আইন যুগোপযোগী হতে হয়। আইনে কোনো দুর্বলতা থাকলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সরকার যথেষ্ট আন্তরিক। পৌরসভা পর্যায়ের বিরোধ নিষ্পত্তিতে বোর্ডকে কীভাবে কার্যকর করা যায়, আইনের কী কী সংশোধন প্রয়োজন, এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার পাওয়া নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। শুধু ঢাকার উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার পেলে হবে না, এটাকে তৃণমূল পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধ নিষ্পত্তিতে পৌর বোর্ড আইনটি সংশোধন এখন সময়ের দাবি।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাদারীপুর লিগ্যাল এইড অ্যাসোসিয়েশনের প্রকল্প সমন্বয়ক মোহাম্মদ ইব্রাহিম মিয়া। তাতে বলা হয়, পৌর বোর্ড আইনটি মূলত অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। পৌর বোর্ডের আওতায় বিচারিক আর্থিক ক্ষমতা ২৫ হাজার টাকা এবং আরও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে বিরোধ মীমাংসা (পৌর এলাকা) বোর্ড আইনটি বিরোধ নিষ্পত্তিতে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না। গ্রাম আদালতের বিচারিক ক্ষমতার আর্থিক এখতিয়ার ৩ লাখ টাকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পথে। এ পরিস্থিতিতে পৌর বোর্ডের আর্থিক এখতিয়ার বৃদ্ধিও জরুরি হয়ে পড়েছে।

প্রবন্ধে বলা হয়, বর্তমানে দেশের আদালতগুলোতে ৪২ লাখ মামলা বিচারাধীন। ৯৪ হাজার ৪৪৪ জনের বিপরীতে বিচারকের সংখ্যা একজন। একজন বিচারকের বিপরীতে মামলার সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৮৮৩। ফলে আদালতে বিরোধ নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। জনগণ আদালতের পরিবর্তে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে বেশি আগ্রহী।

সেমিনারে মাদারীপুর পৌরসভার মেয়র ও ম্যাবের মহাসচিব খালিদ হোসেন বলেন, শুধু ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন জনপ্রতিনিধিদের কাজ নয়। এখন বাজারে একটা ছাগলের দামও ২৫ হাজার টাকা। পৌর বোর্ডের আর্থিক এখতিয়ার কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা করা প্রয়োজন।  

সেমিনারে একাধিক আলোচক পৌর বোর্ডের নিরপেক্ষতা, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের বিষয়টি কীভাবে তদারকি হবে, তা নিশ্চিতে জোর দেন। তারা পৌর বোর্ডের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আপিল করার সুযোগ অবারিত রাখার পক্ষে মত দেন। ইউএনডিপির সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি সরদার এম আসাদুজ্জামান বলেন, পৌর বোর্ডের ক্ষেত্রে তদারকির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। গ্রাম আদালতের ক্ষেত্রেও বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে চেয়ারম্যানদের জবাবদিহি নিশ্চিতের বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি।

সেমিনারে আইনের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২৫ হাজার টাকা মূল্যমান পর্যন্ত বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা, মেয়রের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে আপত্তি বা মেয়রের অনুপস্থিতিতে বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালনের বিষয়টি পরিষ্কার না থাকা, আবেদনপত্র গৃহীত হওয়ার পর সর্বোচ্চ কত দিনের মধ্যে পৌর বোর্ড গঠিত হবে তা উল্লেখ না থাকা, মিথ্যা মামলা দায়ের করা হলে কী হবে তা উল্লেখ না থাকা এবং যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া আবেদন অগ্রাহ্য হলে রিভিশন দাখিল প্রক্রিয়া কী হবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকা অন্যতম।

আইনটি সংস্কারে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। তার মধ্যে পৌর বোর্ড আইনে বিচারিক ক্ষমতার আর্থিক এখতিয়ার ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি, রায় বাস্তবায়ন পদ্ধতি সহজ করা, বোর্ড পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, পৌর বোর্ডের কার্যক্রমে সহায়তার জন্য সিটি পুলিশের বিধান রাখা এবং দ্রুত আইনটির বিধিমালা প্রণয়ন করা অন্যতম।

সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সাবেক অতিরিক্ত সচিব শাহ্‌ মো. আবু রায়হান আল বিরুনী, সাভার পৌরসভার মেয়র আবদুল গণি, পঞ্চগড় পৌরসভার মেয়র জাকিয়া খাতুন, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান প্রমুখ।