রাজধানীর পল্লবীতে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে ছোট ছেলেকে হারান আকলিমা বেগম। এরপর বছর দেড়েক গড়ালেও ছেলে হত্যার বিচার পাননি তিনি। আকলিমার অভিযোগ, এবার তাঁর ভিটেবাড়ির ওপর নজর পড়েছে ছেলের হত্যাকারীদের। এই জমির দখল নিতে তাঁর বড় ছেলেকেও হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, আকলিমার ছোট ছেলে সাহিনুদ্দিনকে (৩৩) হত্যার পরিকল্পনা ও নির্দেশ দিয়েছিলেন লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব এম এ আউয়াল। গত বছরের ১৬ মে সাহিনুদ্দিনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় আকলিমা পল্লবী থানায় মামলা করেন। মামলায় এম এ আউয়ালসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
মামলার তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ১৯৭৫ সালের পরে পল্লবীর বুড়িরটেক–সংলগ্ন আলী নগরে সাহিনুদ্দিনসহ অন্যদের জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। তবে তা দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে ছিল। যাঁদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, সাবেক সংসদ সদস্য আউয়াল তাঁদের পূর্বপরিচিত। তাঁরা এসব জমি অবমুক্ত করার জন্য আউয়ালের কাছে সাহায্য চান। কিন্তু আউয়াল তা দখল করে নিয়ে সেখানে আবাসন গড়ে তোলেন। নিজের প্রতিষ্ঠান হাভেলি প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের মাধ্যমে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন তিনি। জমি দখলে রাখতে আউয়াল ১৫ থেকে ২০ জনের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, জমি ফেরত না পাওয়ায় খুন হওয়ার ২০ দিন আগে এম এ আউয়ালের আবাসিক প্রকল্পের একটি প্লটের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে ফেলেন সাহিনুদ্দিন। এরপর আউয়াল সাহিনুদ্দিন ও তাঁর বড় ভাই মাঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় চাঁদাবাজির মামলা করেন।
‘স্যার, ফিনিশ’
সাহিনুদ্দিন হত্যার একটি সিসি ক্যামেরা ফুটেজে দেখা যায়, দুজন যুবক রামদা ও চাপাতি দিয়ে সাহিনুদ্দিনকে কোপাচ্ছেন। পুলিশ ও র্যাব সূত্র জানিয়েছে, এই হত্যাকাণ্ড-সংশ্লিষ্ট একটি অডিও ক্লিপও তাদের হাতে এসেছে। সেখানে শোনা যায়, হত্যাকারীদের একজন এম এ আউয়ালকে ফোন করে বলছেন, ‘স্যার, ফিনিশ।’ এই কথোপকথন পরীক্ষা করে পুলিশ ও র্যাব নিশ্চিত হয়, কণ্ঠটি সুমন ব্যাপারী নামের এক ব্যক্তির। তিনি সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলার একজন আসামি।
আকলিমা বেগম মামলায় আসামি করেন ২০ জনকে। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ডিবি সূত্র জানায়, মামলায় ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া মনজুরুল হাসান ও মো. বাবুর হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। পরে ডিবি এম এ আউয়ালসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এর মধ্যে ৯ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
আউয়াল বাদে অভিযোগপত্রে থাকা অন্যরা হলেন সুমন ব্যাপারী, টিটু, কিবরিয়া, মুরাদ হোসেন, আবু তাহের, ইব্রাহিম সুমন, রকি তালুকদার, শফিকুল ইসলাম, তুহিন মিয়া, হারুন অর রশীদ, তারিকুল ইসলাম, নুর মোহাম্মদ, হাসান ও ইকবাল হোসেন। তাঁদের মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন এম এ আউয়াল। ১২ জন জামিনে মুক্ত আছেন। বাকি দুজন পলাতক।
এদিকে মাস চারেক আগে ডিবির অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করেন আকলিমা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত হত্যা মামলাটি অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)। নারাজি আবেদনে আকলিমা আরও চার-পাঁচজনকে অভিযোগপত্রভুক্ত করার জন্য মামলার পুনঃতদন্ত চেয়েছেন।
আকলিমা বেগম বলেন, স্থানীয় রাজ্জাকসহ আরও চার-পাঁচজন সাহিনুদ্দিন হত্যায় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি ডিবি কর্মকর্তাদের এই তথ্য দিলেও ওই আসামিদের অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাই ওই আসামিদের নাম অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মামলার পুনঃতদন্ত চান তিনি।
সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলাটি এখন তদন্ত করছেন পিবিআইয়ের পরিদর্শক মনির হোসেন। গত শুক্রবার যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হত্যাকাণ্ডে ১৯-২০ জন জড়িত থাকার কথা নারাজি পিটিশনে উল্লেখ করেছেন বাদী আকলিমা। তিনি মামলার আদ্যোপান্ত তদন্ত করেছেন। সাবেক সংসদ সদস্য আউয়ালকেও রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এখন প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। শিগগিরই আদালতে এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
মাঈনুদ্দিনকে হত্যার ‘হুমকি’
মামলার বাদী আকলিমা বেগম অভিযোগ করেন, এম এ আউয়াল জমির দখল টিকিয়ে রাখতে সাহিনুদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। ওই মামলায় সাহিনুদ্দিন জেলেও গিয়েছিলেন। পরে তাঁকে হত্যা করা হয়।
সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলায় এখন আউয়াল ছাড়া বাকি ১২ আসামি জামিনে মুক্ত আছেন। আকলিমা বেগম বলেন, ডিবির অভিযোগপত্র থেকে রেহাই পাওয়া ও জামিনে মুক্ত থাকা আসামিরা কারাগারে থাকা আউয়ালের নির্দেশে তাঁদের ভিটেবাড়ির দুই একর জমি দখলে নেওয়ার পাঁয়তারা করছেন। কারণ, এখানে এক কাঠা জমির দাম ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। আসামিরা তাঁকে গালাগাল করছেন এবং তাঁর বড় ছেলে মাঈনুদ্দিনকে প্রকাশ্যে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন। ছেলের প্রাণনাশের আশঙ্কায় গত সপ্তাহে পল্লবী থানায় জিডি করেছেন তিনি।
সাহিনুদ্দিনের মায়ের করা জিডির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাহিনুদ্দিনের মা কয়েক দিন পরপরই থানায় জিডি করেন। তাঁদের ওপর যেন হামলা বা কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়ে পুলিশের নজরদারি আছে।