কিশোরীদের জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধের টিকা দিতে কার্যক্রম শুরু

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে সুবিধাবঞ্চিত ও শ্রমজীবী কিশোরীদেরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে এইচপিভি (হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস) টিকা দেওয়ার জন্য সারা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মেয়েশিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়েছে। এই তথ্য সংগ্রহের পর ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী অর্থাৎ পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েশিক্ষার্থীদের এক ডোজ করে টিকা দেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ৪ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এ ব্যাপারে চিঠি পাঠানো হচ্ছে।

এর আগে ২০১৬ সালে সরকারিভাবে গাজীপুরে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার ১০ বছর বয়সী মেয়েশিশুকে এইচপিভি টিকা দেওয়া হয়েছিল। ছয় মাসের মধ্যে দুই ডোজ টিকা দেওয়ার মাধ্যমে প্রকল্পটি শেষ হয়। এরপর আর টিকা কর্মসূচিটি বিস্তৃত হয়নি। এর পাঁচ বছরের মাথায় ২০২১ সালের ১২ মার্চ এইচপিভি টিকার জন্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস (গ্যাভি) বাংলাদেশকে অনুমোদন দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের জুলাইয়ে দেশজুড়ে এইচপিভি টিকা কর্মসূচি শুরুর পরিকল্পনা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি।

ইপিআই থেকে জানা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হালনাগাদ সুপারিশে এক ডোজ টিকাই কার্যকর বলে জানানো হয়েছে। এক কোটির বেশি কিশোরীকে লক্ষ্য রেখে টিকার কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে সুবিধাবঞ্চিত ও শ্রমজীবী কিশোরীদেরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

২০২১ সালের ১২ মার্চ এইচপিভি টিকার জন্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস (গ্যাভি) বাংলাদেশকে অনুমোদন দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের জুলাইয়ে দেশজুড়ে এইচপিভি টিকা কর্মসূচি শুরুর পরিকল্পনা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি।

তথ্য সংগ্রহের কাজ দ্রুত শেষ করা হবে

জরায়ুমুখ ক্যানসারের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে—অতিরিক্ত সাদা স্রাব, অতিরিক্ত রক্তমিশ্রিত স্রাব, সহবাসের পর রক্তস্রাব, অনিয়মিত মাসিক ও তলপেটে ব্যথা। ২০২১ সালে বিশ্বে ক্যানসার–বিষয়ক গবেষণার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ক্যানসার রিসার্চ ইউকে জানায়, যুক্তরাজ্যের ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সী যে মেয়েরা এইচপিভি টিকা পেয়েছে, তাদের মধ্যে জরায়ুমুখের ক্যানসার আক্রান্তের হার ৯০ শতাংশ কমেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যানসার গবেষণাবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইএআরসির সবশেষ ২০২০ সালের গ্লোবোক্যান প্রতিবেদন অনুসারে, জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্তের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বছরে নতুন করে আক্রান্ত হন ৮ হাজার ২৬৮ জন এবং বছরে মারা যান ৪ হাজার ৯৭১ জন।

ইপিআইয়ের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক এস এম আবদুল্লাহ আল মুরাদ প্রথম আলোকে বলেন, কত শিক্ষার্থীকে টিকা দিতে হবে, তা জানার জন্য সরকারি-বেসরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। একটা ফর্মে তথ্য নেওয়া হচ্ছে। কাজটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। গ্যাভি থেকে এইচপিভি টিকা এখনো হাতে আসেনি। তিনি জানান, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সেপ্টেম্বরের মধ্যে টিকা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। যত দ্রুত সম্ভব, তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ করা হবে।

অভিভাবকেরা সাড়া দিচ্ছেন

জাতীয় শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুারো (ব্যানবেইস) ২০২১–এর তথ্য অনুসারে, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে দেড় লাখের মতো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

রাজধানীর ধানমন্ডির অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের উপাধ্যক্ষ (মাধ্যমিক স্কুলের) শারমীন মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, এ মাসে তাঁরা চিঠি পেয়েছেন টিকা দেওয়ার বিষয়ে। পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েশিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাছে ফর্মে পাঠিয়েছেন। যে অভিভাবকেরা টিকা দেওয়ার বিষয়ে সম্মতি দেবেন, তাঁদের মেয়েদের নাম পাঠানো হবে। তিনি বলেন, এটা খুব ভালো একটি উদ্যোগ। অভিভাবকেরা ভালো সাড়া দিচ্ছেন।

তথ্য পাঠানোর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় বেঁধে দেওয়া আছে কি না, তা জানতে চাইলে শারমীন মাহমুদ বলেন, যত দ্রুত সম্ভব ফরম পূরণ করে পাঠাতে বলা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরায়ুমুখের ক্যানসারের ক্ষেত্রে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের ৯০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনা; ৩৫ ও ৪৫ বছর বয়সে অন্তত দুবার স্ক্রিনিং বা পরীক্ষা করা এবং ৯০ শতাংশকে চিকিৎসার আওতায় আনার লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছে।

অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের এক ছাত্রীর অভিভাবক শাহানা হুদা প্রথম আলোকে বলেন, স্কুল থেকে যে ফরমটি তাঁদের দেওয়া হয়েছে, তাতে সেপ্টেম্বরে টিকা দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। টিকা দেওয়ার উদ্যোগকে প্রশংসনীয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি আমার নাতনিকে পুরো বিষয় সম্পর্কে জানিয়েছি এবং টিকা নেওয়া কেন জরুরি, তা–ও বলেছি।’

রাজধানীর তুরাগের বাউনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর কবীর খান বলেন, এইচপিভি টিকা দেওয়ার বিষয়ে তিনি এখনো চিঠি পাননি।

এ বিষয়ে ইপিআইয়ের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক এস এম আবদুল্লাহ আল মুরাদ জানান, যেসব প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত, সেসব প্রতিষ্ঠানের মেয়েরাও এর আওতায় পড়বে। সেসব প্রতিষ্ঠানেও চিঠি পাঠানো হবে।

কিশোরীদের টিকা দিলে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ হতে পারে। তবে সর্ম্পূণ ঝুঁকি এড়াতে ওই কিশোরীদের ৩০ বছরের বেশি বয়স হলে অবশ্যই ভায়া পরীক্ষা করা উচিত।
অধ্যাপক আশরাফুন্নেসা, পরিচালক, ইলেকট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার পরীক্ষা কর্মসূচি

৩০-এর বেশি বয়সী নারীদের ‘ভায়া’ পরীক্ষা করা উচিত

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরায়ুমুখের ক্যানসারের ক্ষেত্রে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের ৯০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনা; ৩৫ ও ৪৫ বছর বয়সে অন্তত দুবার স্ক্রিনিং বা পরীক্ষা করা এবং ৯০ শতাংশকে চিকিৎসার আওতায় আনার লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অনকোলজি ভবনের ছয়তলায় স্থাপিত জাতীয় জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রে বিনা মূল্যে ভায়া (ভিজুয়্যাল ইন্সপেকশন অব দ্য সারভিক্স উইথ অ্যাসেটিক অ্যাসিড) পরীক্ষা করা হয়। কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, দেশে এখন পর্যন্ত ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী মাত্র ২০ শতাংশ নারীকে ভায়া পরীক্ষার আওতায় আনা গেছে।

আরও পড়ুন

জাতীয় জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রের অধীন ‘ইলেকট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার পরীক্ষা কর্মসূচির’ পরিচালক অধ্যাপক আশরাফুন্নেসা প্রথম আলোকে বলেন, কিশোরীদের টিকা দিলে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ হতে পারে। তবে সর্ম্পূণ ঝুঁকি এড়াতে ওই কিশোরীদের ৩০ বছরের বেশি বয়স হলে অবশ্যই ভায়া পরীক্ষা করা উচিত।

ভায়া পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো নারীর জরায়ুমুখ ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে কি না, তা ১০ বছর আগেই শনাক্ত করা সম্ভব উল্লেখ করে অধ্যাপক আশরাফুন্নেসা আরও বলেন, এতে দ্রুত চিকিৎসা শুরুর মাধ্যমে জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূল করা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন