জাতিসংঘের দুই সংস্থার প্রতিবেদনে ‘ভুল’ তথ্যের বিষয়ে আপত্তি সরকারের

জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম (জেএমপি) শীর্ষক প্রতিবেদনছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে সুপেয় পানির সরবরাহ, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে জাতিসংঘের দুই সংস্থার জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম (জেএমপি) শীর্ষক ২০২৩ সালের প্রতিবেদনের তথ্যের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে সরকার।

সরকারের অভিযোগ, জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তৈরি করা এই বৈশ্বিক প্রতিবেদনে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জেএমপির ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে সুপেয় পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন দুই বছর আগে দেওয়া প্রতিবেদনের চেয়ে কমিয়ে দেখানো হয়েছে। এমন প্রতিবেদনের ফলে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দলিল বা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) মতো দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা জটিলতার মুখে পড়তে পারে। জেএমপির এই প্রতিবেদনটির কারণে বিশেষ করে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন বৈশ্বিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ স্থানীয় সরকার ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। তারা জাতিসংঘের দুই সংস্থাকে এসব ভুল ঠিক করে নতুন প্রতিবেদন তৈরি করতে বলেছে। এ নিয়ে কথা বলতে জেএমপির দুই কর্মকর্তা বাংলাদেশে এসেছেন। গতকাল বুধবার ও আজ বৃহস্পতিবার সরকারের একাধিক দপ্তরের সঙ্গে তাঁদের বৈঠক করার কথা।

জেএমপি প্রতিবেদন কী

জেএমপি প্রতিবেদনে সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন-সংক্রান্ত বৈশ্বিক তথ্য-উপাত্ত উঠে আসে। বিভিন্ন দেশের কাছে থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত নিয়ে দুই বছর পরপর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

জাতিসংঘের সংস্থা দুটির (ইউনিসেফ-ডব্লিউএইচও) দায়িত্ব হলো, সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা।

তবে বাংলাদেশের অভিযোগ, জেএমপির সর্বশেষ প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করেনি জাতিসংঘের সংস্থা দুটি।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগকে চিঠি দেয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। এই চিঠিতে অভিযোগগুলো স্পষ্ট করা হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, জেএমপির ২০২৩ সালের প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার বা জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা হিসেবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সঙ্গে কোনো ধরনের পরামর্শ বা মতামত গ্রহণ করা হয়নি।

বিবিএসের এসডিজি সেলের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেএমপির প্রতিবেদন তৈরির সময় আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। আমাদের কাছে তথ্য-উপাত্ত ছিল। কিন্তু সেগুলো না নিয়েই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।’

এসব বিষয়ে আলোচনার দায়িত্ব ডব্লিউএইচও বা ইউনিসেফের দেশীয় কার্যালয়ের। ঢাকায় ইউনিসেফের ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন অফিসার সৈয়দ আদনান ইবনে হাকিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা মহামারিকালে নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। তাই যোগাযোগটা করা হয়ে ওঠেনি।’

কী আছে প্রতিবেদনে

সরকার বলছে, সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনব্যবস্থার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত। কিন্তু জেএমপির এবারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রে পিছিয়েছে।

২০১৫ সালকে ভিত্তি বছর ধরে জেএমপির ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে স্যানিটেশনের আওতায় আছে ৩৪ শতাংশ মানুষ। কিন্তু জেএমপির ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে এই হার ২৩ শতাংশ দেখানো হয়েছে। অথচ বিবিএসের প্রাক্কলন, এই হার ৫০ শতাংশের বেশি হবে।

২০১৯ সালে জেএমপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে হাত ধোয়া বা স্বাস্থ্যবিধির আওতায় ছিল ৪০ শতাংশ মানুষ। তবে জেএমপির এবারের প্রতিবেদনে তা দেখানো হয়েছে ৪২ শতাংশ। বিবিএসের ২০২০ সালের বহুনির্দেশক গুচ্ছ জরিপ (মিকস) অনুসারে, এই হার ৭৪ শতাংশের বেশি।

শহরে নিরাপদ পানির আওতায় থাকা মানুষের হার জেএমপির ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে ৪৭ শতাংশ দেখানো হয়েছিল। জেএমপির সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই হার একই রকম দেখানো হয়েছে। যদিও বিবিএসের জরিপ অনুসারে, এই হার ৫৪ শতাংশ।

‘ভুল’ বনাম ‘ভুল-বোঝাবুঝি’

সরকার ইতিমধ্যে প্রতিবেদনটির ‘ভুল’ তথ্যের প্রমাণ ‍তুলে ধরে বিষয়টি জেএমপিকে জানিয়েছে। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেএমপির দেওয়া আগের তথ্য আমরা নানা দলিলে ব্যবহার করেছি। এখন সেটাকে তারা কমিয়ে দিয়েছে। তাদের এখন ভুল শোধরাতে হবে। আমরা এ নিয়ে আমাদের কথা জেএমপিকে জানিয়ে দিয়েছি।’

তবে ইউনিসেফের কর্মকর্তা সৈয়দ আদনান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ঠিক ভুল নয়। আসলে কিছু ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে। আমরা আমাদের পদ্ধতি ব্যবহার করে তথ্য-উপাত্ত দিয়েছি। আর এখন আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসছি। সেখানেই বিষয়গুলো বলা হবে।’

পরিকল্পনা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলছে, জেএমপির প্রতিবেদনের তথ্যে বড় ধরনের ভুল আছে। সরকার চায়, জেএমপির এই প্রতিবেদন প্রত্যাহার করা হোক।