কবিতা উৎসবে ইসরায়েলের হামলার সমালোচনা
‘যুদ্ধ গণহত্যা সহে না কবিতা’ এই শিরোনামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বরে চলছে জাতীয় কবিতা উৎসব।
জাতীয় কবিতা পরিষদের ৩৬তম এই আয়োজনের সমাপনী দিন আজ শুক্রবার। দিনের আয়োজন শুরু হয়েছে একটি সেমিনারের মধ্য দিয়ে। এতে অংশ নিয়ে বিশিষ্টজনেরা ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের সমালোচনা করেছেন।
আজ বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বরে স্থাপিত মঞ্চে সেমিনারের মধ্য দিয়ে কবিতা উৎসবের সমাপনী দিনের আয়োজন শুরু হয়। এরপর শুরু হয়েছে কবিতাপাঠ। বিকেলে জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কারপ্রাপ্ত কবির নাম ঘোষণা করবে। অনুষ্ঠান শেষ হবে রাত নয়টায়।
সেমিনারে ‘যুদ্ধ গণহত্যা সহে না কবিতা’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রাবন্ধিক ও গবেষক মফিদুল হক। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল-পরিচালিত গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। মানবিক মূল্যবোধের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত রাষ্ট্রগুলোর দ্বিচারিতা ও অনৈতিকতার বিপরীতে পূর্ব থেকে ঘটছে নতুন জাগরণ। বাংলাদেশও ওই মামলায় অন্যতম রাষ্ট্রপক্ষ হিসেবে যোগ দিয়েছে। পাল্টে যাওয়া নতুন পৃথিবীর প্রত্যাশায় আমরা রইলাম। কবিতা মানুষে-মানুষে সংযোগের যে বাণী মন্ত্র বহন করে, নতুন মানবিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় সেই কবিতাই আমাদের আশ্রয়।’
পরে আলোচনায় অংশ নিয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের মধ্যে কবিরাও ছিলেন। কবিদের প্রধান শত্রু মনে করেছে গণহত্যাকারীরা। কবিরা গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন। একাত্তরের ঘাতক দলাল নির্মূল কমিটি ও গণআদালতেও কবি-শিল্পীরা ছিলেন। কবিতা প্রতিরোধের শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।’
গণহত্যা এখন একটি রাজনীতির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে—এমন মন্তব্য করে সেমিনারে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘ফিলিস্তিনে গণহত্যার কথাটা কেউ সোচ্চারভাবে বলছে না। পাশ্চাত্যও এখন গণহত্যাকে গণহত্যা বলছে না। তবে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা হত্যা-গণহত্যার বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার থেকেছেন। গণহত্যার স্মৃতিটা তাঁরাই সব সময় উজ্জীবিত রাখেন।’
মুনতাসীর মামুন আরও বলেন, ‘কবিতা উৎসব আমাদের এখানে প্রতিরোধের একটি প্রতীক। আমরা চাই, এটা অক্ষুণ্ন থাকুক। কারণ, ভবিষ্যতে আমরা যে বাংলাদেশ দেখব বলে আশঙ্কা করছি, সেটি খুব শুভ নয়। এরই মধ্যে মিছিলে লোক কমে গেছে। আগের মতো সে রকম সোচ্চার কেউ নেই। নতুন কোনো জোয়ারও আমরা দেখিনি। হয়তো সেটা আমাদের ব্যর্থতা।’ভারতে
র কবি ও পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমির সভাপতি সুবোধ সরকার বলেন, ‘এক হাতে বোমা, আরেক হাতে কয়েকটা শিউলি ফুল। এই মানবসভ্যতা শেষ পর্যন্ত ওই শিউলি ফুলের হাতের দিকেই এগিয়ে আসবে।’
নেপালের কবি বিধান আচার্য বলেন, মানুষের গন্তব্য হচ্ছে সুখ। কবিতা মানুষকে সেই গন্তব্যে যেতে সাহায্য করে। একজন কবি ঘৃণার বিপরীতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে পারেন। আসুন, আমরা এখান থেকে শপথ নিই ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-লিঙ্গ ঊর্ধ্বে উঠে ভালোবাসা ও সংহতির জন্য লিখব।’
ত্রিপুরার আগরতলা থেকে আগত কবি দিলীপ দাস বলেন, ‘আর কতকাল আমাদের উচ্চারণ করতে হবে “যুদ্ধ গণহত্যা সহে না কবিতা?” ইসরায়েল একটা জাতিকে ধ্বংস করার জন্য বর্বর বিক্রম দেখাচ্ছে৷ এই বর্বরতার বিরুদ্ধে যে কবিরা প্রতিবাদ করেছেন, সেই প্রতিবাদ খুবই মৃদু৷ আমরা এখন কবিতা লিখি নিজেদের মধ্যবিত্ত ধূর্ত সুখকে পরিতুষ্ট করার জন্য৷ আমাদের হয়তো সততা আছে, কিন্তু তা কার্যকরে সৎ উদ্যোগ নেই৷’
ইরানের কবি ও অধ্যাপক মাজিদ পুইয়ান সেমিনারে ফারসিতে বক্তব্য দেন। তাঁর বক্তব্য বাংলায় অনুবাদ করে দর্শক-শ্রোতাদের শোনান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসির শিক্ষক মো. বাহাউদ্দিন৷ মাজিদ বলেন, ‘আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ কী৷ পৃথিবী একটা জাহাজের মতো এবং মানুষ হচ্ছে এর যাত্রী। একজন কবি, শিক্ষক বা শিল্পসত্তাসম্পন্ন কেউ যদি একটা জাহাজকে ছিদ্র হয়ে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে দেখতে পান, তখন তার দায়িত্ব কী হবে? দূর থেকে সবার বিপদ দেখে তিনি সবাইকে কীভাবে বাঁচানো যায়, সেটি তার প্রধান চিন্তা হবে। এই দায় বোধ না করলে তিনি মানুষই নন। আমাদের সবার সেই চিন্তাটাই করতে হবে যে আমরা সবাই একই জাহাজের বাসিন্দা। অন্য মানুষের কষ্টকে যে নিজের কষ্ট মনে করতে পারে না, তাকে মানুষ বলা যায় না।’
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। তিনি বলেন, ‘একজন সংস্কৃতিকর্মী বা লেখক হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা খুবই বিপন্ন ও অসহায় বোধ করি৷ কবিতা, গান ও নাটকের মাধ্যমে আমরা হয়তো যুদ্ধ বন্ধ করতে পারব না। কিন্তু যুদ্ধের বিরুদ্ধে একটা সোচ্চার কণ্ঠ তো আমরা জারি রাখতেই পারি। যখন দেখি গাজায় ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর কোনো প্রতিবাদ নেই; তার পরিবর্তে তারা আমাদের দেশে এসে আমাদের মানবাধিকার নিয়ে বড় বড় কথা বলে—ধিক, তাদের এই দ্বিচারিতার।’ বর্তমান সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে জাতীয় কবিতা পরিষদের উদ্যোগে একটি কবিতা সংকলন প্রকাশের পরামর্শ দেন তিনি।