দুর্ঘটনার পরও নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়নি

দুর্ঘটনাস্থলের পাশে ক্রেন ও গার্ডার পড়ে আছে। প্রকল্প ঘিরে কোনো রকম নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই।

ফাইল ছবি

রাজধানীর ব্যস্ততম বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রেখে দিনের পর দিন ঝুঁকি নিয়েই বাস র‍্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) উড়ালসড়কের গার্ডার ওঠানোর কাজ চলেছে। জানমালের নিরাপত্তায় কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গত সোমবার গার্ডারের চাপায় প্রাইভেট কারের পাঁচ আরোহী নিহত হন। এরপরও উত্তরায় বিআরটির নির্মাণাধীন এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

গতকাল মঙ্গলবার বিমানবন্দর থেকে রাজলক্ষ্মী পর্যন্ত প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, উড়ালসড়কের গার্ডার স্থাপনের কাজ আপাতত বন্ধ রয়েছে। সড়কের মাঝখানে একটার ওপরে আরেকটা স্তূপ করে গার্ডার রাখা।

দুর্ঘটনাস্থলের পাশে ক্রেন ও গার্ডার পড়ে আছে। প্রকল্প ঘিরে কোনো রকম নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই। বিভিন্ন জায়গায় নির্মাণসামগ্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। কংক্রিটের স্ল্যাব থেকে লোহার রড বেরিয়ে রয়েছে। সড়কে বালুর স্তূপ ঢেকে রাখা হয়নি। এতে বাতাসে বালু উড়ছে।

দুইটা টাকা লাভের জন্য নিরাপত্তা ছাড়াই ব্যস্ত রাস্তায় গার্ডার ঝুলিয়ে রেখেছে তারা। আমার তো সব শেষ হয়ে গেল। তারা আমার এমন সর্বনাশ করল।
রিয়া আক্তার, দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া আরোহী

গতকাল সকালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম দুর্ঘটনাস্থলে আসেন। তাঁর বাসা উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরে। দুর্ঘটনাস্থলের সামনে দিয়েই তিনি প্রতিদিন যাতায়াত করেন।

খামখেয়ালির কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে মন্তব্য করে গতকাল মেয়র সাংবাদিকদের বলেন, কাজের কমপ্লায়েন্স (নিরাপত্তাব্যবস্থা ও অন্যান্য নিয়ম) মানা হলে এ দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। এখানে কাজের শর্তাবলির কোনো কিছু মানা হয়নি। কোনো নিরাপত্তা নেই। ওপরে ঝালাইয়ের কাজ করছে। আগুনের স্ফুলিঙ্গ নিচে ছিটকে পড়ছে। এখানে কোনো সাইনবোর্ড পর্যন্ত লেখা নেই যে এখানে বা এদিকে কাজ চলছে।

আতিকুল ইসলামের সঙ্গে দুর্ঘটনাস্থলে আসেন বিআরটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিকুল ইসলাম। তিনি খামখেয়ালিপনার দায় ঠিকাদারের ওপর চাপিয়ে বলেন, ‘আসলে ঠিকাদারদের কাছ থেকে আমরা এই খামখেয়ালিপনা পাচ্ছি। কোনোভাবেই আমরা তাদের কমপ্লায়েন্সে আনতে পারছি না।’

আরও পড়ুন

সড়কের ওপর নির্মাণকাজ চলার সময় যানবাহন ও মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রকল্পের কাজের অংশ। এ জন্য নির্মাণ এলাকা ঘিরে রাখার নিয়ম। কিন্তু প্রায় এক দশক ধরে চলা বিআরটি প্রকল্পে এর কিছুই মানা হয়নি।

দুর্ঘটনাস্থলের কাছের একটি বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী আবদুল খালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই দেখছি, সড়কে গাড়ি চলার মধ্যেই ক্রেন দিয়ে গার্ডারসহ ভারী জিনিস ওপরে তোলা হচ্ছে। আজ না হয় কাল এমন একটা দুর্ঘটনা হতোই।’

প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিমানবন্দরের সামনের সড়কের মাঝবরাবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে। কোনো ধরনের নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকায় পাশ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলছে। নির্মাণ এলাকায় সড়ক অসমান, এবড়োখেবড়ো। ফলে যানবাহন, বিশেষ করে মোটরসাইকেলের চালকদের দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে।

নির্মাণাধীন প্রকল্প এলাকার কর্মপরিবেশ নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাণকাজের সময় যেসব প্রক্রিয়া মেনে চলার কথা, তার কোনোটাই এখানে অনুসরণ করা হয়নি। ঠিকাদার কী কী বিষয় মেনে কাজ করবেন, তা নির্ধারিত থাকে। এই অনুমোদিত প্রক্রিয়ায় কাজ চলছে কি না, তা দায়িত্ব প্রদানকারী সংস্থার পাহারা দেওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে তা হয়েছে কি না, সন্দেহ রয়েছে।

অন্যান্য দিনের মতো গতকালও বিমানবন্দর থেকে উত্তরা পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে গাড়ির চাপ ছিল। স্থানীয় লোকজন, পথচারী ও যাত্রীদের অনেকেই আগের দিন ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছেন। তাঁদের মতে, যে কেউ এ দুর্ঘটনার শিকার হতে পারত। নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

সোমবার দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িতে থাকা নবদম্পতি রিয়া আক্তার ও রেজাউল করিম (হৃদয়) বেঁচে যান। গতকাল দুপুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে আসেন রেজাউল ও রিয়া। রিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুইটা টাকা লাভের জন্য নিরাপত্তা ছাড়াই ব্যস্ত রাস্তায় গার্ডার ঝুলিয়ে রেখেছে তারা। আমার তো সব শেষ হয়ে গেল। তারা আমার এমন সর্বনাশ করল।’