ইলা মিত্রের মামলার সেই নথি

ইলা মিত্র

৭২ বছর আগের কাগজ। খসে খসে পড়ছে। তার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে ইংরেজি হরফে হাতে লেখা একটি শব্দ ‘ক্রাউন’। আদালতের পরিভাষায় ক্রাউন এখানে রাষ্ট্র। মানে পাকিস্তান রাষ্ট্র। বাদী বা অভিযোগকারীর ঘরে লেখা আছে এই শব্দ। তার নিচে বিবাদী বা অভিযুক্তের ঘরে লেখা ইলা মিত্র অ্যান্ড ২২ আদারস।

ইলা মিত্র মানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী। শোষিত ও নিপীড়িত সাঁওতাল কৃষকদের রানিমাখ্যাত বিপ্লবী। ১৯৪৯ সালে নাচোলের কৃষক বিদ্রোহে নিহত পুলিশের পক্ষে করা মামলার নথি এটি।

কয়েক দিন আগে রাজশাহীর জেলা জজ আদালতের রেকর্ড রুমে ঢুকে ১৯৫০ সালের মামলার এই নথি নেড়ে দেখার সুযোগ হয়।

মোটা কাগজে জড়িয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা। দড়ি খুলতেই বের হলো নীল রঙের মলাট। লাল কালি দিয়ে তার ওপরে লেখা ‘ইলা মিত্রের নথি।’ এর ওপরে হাত রাখতেই গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে হলো, হাতের নিচে ইলা মিত্রের রক্তে ভেজা ছেঁড়া আঁচল, তাঁর প্রিয় নাচোল।

ইলা মিত্রের মামলার নথিটি রাজশাহী জেলা জজ আদালতের রেকর্ডরুমে সংরক্ষিত আছে
ছবি: প্রথম আলো

পাতা ওলটাতে হচ্ছে খুবই সতর্ক হয়ে। তা ছাড়া হাতের সঙ্গে ধরা অংশটিই খুলে আসছে। চোখে পড়ল মামলার সেই সাজানো এজাহার। বাদী নাচোল গ্রামের গাড়োয়ান লালু নাথ কর্মকার। ইংরেজিতে টাইপ করা এই এজাহারে বাদ পড়া অংশগুলো আবার তির চিহ্ন দিয়ে পাশে হাতে লিখে দেওয়া হয়েছে।

যেমন পুলিশের ওপরে হামলার সময় সাঁওতাল কৃষকদের হাতে কী ছিল, তা টাইপ করার সময় বাদ পড়ে যায়। পরে বাঁ পাশে হাতে লিখে দেওয়া হয়েছে তাদের হাতে লাঠিসোঁটা ছিল। আরও দুটি জিনিসের কথা বলা হয়েছে, তার পাঠোদ্ধার করা যাচ্ছে না। এগুলো হুবহু রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে এসব যেন সেই নাচোল নির্যাতনের ক্ষত চিহ্ন। পাওয়া গেল ১৯৫০ সালের ১৬ জানুয়ারি কে আহমেদ নামের একজন ম্যাজিস্ট্রেট স্বাক্ষরিত ইলা মিত্রের জবানবন্দির একটি অনুলিপি। এটাকে ‘স্টেটমেন্ট’ বলা হয়েছে। সবটা পরিষ্কার পড়া যায় না। যতটুকু পড়া যায়, তা ঘটনার বর্ণনা। ‘...আমি ও বৃন্দাবন ভোরে রহনপুর রওনা হই।...আনুমানিক বেলা ১০টার সময় সেখান থেকে আমাকে ও বৃন্দাবনকে গ্রেপ্তার করা হয়।’ এখানেই শেষ।

ইলা মিত্রের নির্যাতনের জবানবন্দি আগেই মালেকা বেগমের লেখা ইলা মিত্র, নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী বইতে পড়া ছিল। রক্ত হিম হয়ে আসা সেই মর্মন্তুদ বর্ণনা। সেটা গ্রেপ্তারের পরের ঘটনা। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য দুটি লাঠির মধ্যে দুই পা ঢুকিয়ে চাপ দেওয়া, যৌনাঙ্গে গরম ডিম ঢুকিয়ে দেওয়া, এমনকি ধর্ষণও বাদ রাখা হয়নি।

দেখা গেল রাজশাহী জেলা জজ আদালতে একজন দায়রা জজ ও আটজন বিশেষ জুরি মিলে রায় দিয়েছেন। এই নয়জনের মধ্যে একজন ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের রায়ে ইলা মিত্রকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৫২ সালের ৩ এপ্রিল হাইকোর্টের বিচারক মি. ইলিচ ও ইস্পাহানির দ্বৈত বেঞ্চে নিম্ন আদালতের দণ্ড রহিত করে মামলা পুনর্বিচারের জন্য ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু পরে আবার একই রায় বহাল রাখা হয়।

আপিলের নথি ওলটাতে গিয়ে ২৩ জন আসামির মধ্যে ৪ নম্বরে দেখা গেল বৃন্দাবন সাহার নাম। তার ২৪ বছর সাজা হয়েছিল। তিনি ১০ বছর জেল খেটে মুক্তি পেয়েছিলেন। দুটি বিদ্রোহের কথা বইয়ে তিনি লিখেছেন, গরুর গাড়িতে হরেক মন্ডলের মৃতদেহ আগেই তোলা ছিল। একই সঙ্গে তাঁকে পোড়ানোর জন্য কাঠ কেরোসিন প্রস্তুত করা হয়েছিল। দুজন সিপাই তাঁর পায়ে দড়ি বেঁধে সেই গাড়িতে তুলবে। এমন সময় দারোগা মমতাজ মিঞা বললেন, ‘হে থাক। আজকের রাতটা নেতা থাক। কাল দিনের বেলায় বেশি কেরোসিন আর কাঠ জোগাড় করে নিয়ে কাল রাতে ওকে জ্যান্ত পুড়িয়ে দিও।’

আপিলে সেই রায় বহাল হলো। শুধু হরেক মন্ডলকেই পোড়াতে নিয়ে যাওয়া হলো। এই হরেক মন্ডল সেই কৃষক, যিনি একদিন গরু খুঁজতে গিয়ে পার্টির দায়িত্ব পালন করতে পারেননি বলে রানিমায়ের বকা খেয়েছিলেন। থানায় ধরা পড়ার পর ইলা মিত্রের সামনে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হলেও তাঁর মুখ দিয়ে পুলিশ হত্যার হুকুমদাতা হিসেবে ইলা মিত্রের নাম বের করা যায়নি।

১৯৫৪ সালে চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হলে ইলা মিত্র কলকাতায় চলে যান।

কালের সাক্ষী এই মামলার নথিটি সংরক্ষণ করা জরুরি।

ইলা মিত্র বিয়ের আগেই বিএ পাস করেছিলেন। ১৯৪০ সালে প্রথম বাঙালি মেয়ে হিসেবে জাপানে অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। শহুরে শিক্ষা আর রক্ষণশীল জমিদারবাড়ির বউ হয়েও নাচোল কৃষক বিদ্রোহের সংগ্রামী আদর্শে দিক্ষিতা বিপ্লবী ইলা মিত্র হয়ে উঠেছিলেন সাঁওতাল কৃষকের রানিমা।

আজ ১৮ অক্টোবর ৯৮তম জন্মদিনে এই অসমসাহসী নারীর প্রতি শ্রদ্ধা।