চিকুনগুনিয়া কি আবার ভোগাবে, ক্ষতির আভাস দিচ্ছে বৈশ্বিক গবেষণা

ডেঙ্গু মশাপ্রতীকী ছবি

রাজধানীর ধানমন্ডিতে একটি বেসরকারি হাসপাতালে রোগী দেখেন বিশিষ্ট চিকিৎসক অধ্যাপক টিটো মিঞা। তাঁর চেম্বারের সামনে চিকিৎসা উপদেশ দিয়ে নানা লেখা আছে, যেমনটা অনেক চিকিৎসকের চেম্বারের সামনেই থাকে। এমন একটি চিকিৎসা পরামর্শ দেখা গেল চিকুনগুনিয়া নিয়ে। চিকুনগুনিয়া এখন এই মে মাসে কোথাও বড় আকারে ছড়াচ্ছে বা ইতিমধ্যেই প্রকট আকার নিয়েছে, এমন ঘটনা নেই। তারপরও এ নিয়ে সাবধানবাণী কেন?

ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ টিটো মিঞা বলছিলেন, ‘গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের একেবারে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কিছু রোগী পাচ্ছিলাম, যারা জ্বরের সঙ্গে র‍্যাশের পাশাপাশি শরীরে বাতের ব্যথা নিয়ে আসত। ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে এমন অবস্থা সন্দেহজনক ছিল। আমি সেসব রোগীকে পরীক্ষা করিয়ে চিকুনগুনিয়া নিশ্চিত হয়েছি। আমি নিজে অন্তত ৩০ রোগী পেয়েছি। আমার পরিচিত অনেক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এমন রোগী পেয়েছেন।’

অধ্যাপক টিটো মিঞা

ডা. টিটো মিঞা জানান, এখন অনেকেই বাতের ব্যথা নিয়ে তাঁর কাছে আসেন। রোগের ইতিহাস জানতে চাইলে অনেকেই বলছেন, আগে তাঁদের জ্বর হয়েছিল।

তার অর্থ হলো, অনেকেই হয়তো চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, কিন্তু সে সময় নির্ণীত হয়নি, বলছিলেন টিটো মিঞা। এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞের ধারণা, কয়েক বছরের বিরতি দিয়ে চিকুনগুনিয়া বাংলাদেশে ফেরত আসছে। আর এর প্রকোপ এবার বাড়তে পারে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) এক গবেষণায় দেখা যায়, গত বছর অক্টোবর থেকে ঢাকা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় চিকুনগুনিয়া রোগের সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়ার বড় ধরনের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা আছে নিকট ভবিষ্যতে। এর একাধিক কারণও আছে। সেগুলোর মধ্যে আছে দীর্ঘদিন ধরে এ অসুখ না থাকায় এ ভাইরাসের ‘খোলা মাঠ’, এডিস অ্যালবোপিকটাসের বিস্তৃতি এবং দেশে এর মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকা।

দীর্ঘ সময় ধরে এ রোগের প্রতিক্রিয়া থাকায় বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতিও হতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া হাত ধরাধরি করে আসে। এখন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আগের যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি। এর নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত সরকারি যথেষ্ট তৎপরতাও দেখা যাচ্ছে না। এ–সংক্রান্ত গবেষণা বিজ্ঞানভিত্তিক সাময়িকী সায়েন্স ডিরেক্টে প্রকাশিত হয়।

চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি কেমন

চিকুনগুনিয়া ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশাবাহিত রোগ। এ রোগে ডেঙ্গুর মতোই জ্বর আসে। বাড়তি উপসর্গ হলো, শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুর ঘটনা তেমন না থাকলেও এর ফলে হওয়া ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয়।

বাংলাদেশে ২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের বড় প্রাদুর্ভাব হয়। এরপর এই ভাইরাস প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। ২০২৪ সালের শেষের দিকে আবার ফিরে আসে।

গবেষণায় বলা হয়, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত সন্দেহজনক ৩৯৪ ব্যক্তিকে পরীক্ষা করে ১৩৮ বা ৩৫ শতাংশ ব্যক্তির দেহে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শনাক্ত করা হয়।

চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২৮ দিন পরও ৮১ শতাংশ রোগীর কমপক্ষে একটা লক্ষণ রয়ে গেছে। সবচেয়ে সাধারণ যে লক্ষণটি দেখা গেছে, তা হলো শরীরের বিভিন্ন গাঁটে ব্যথা।

গবেষণায় দেখা গেছে, গত বছর আক্রান্ত হওয়া রোগীদের গড়ে সাড়ে ১০ কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের জনপ্রতি প্রতিদিন গড় আয় ৬ দশমিক ৯৮ ডলার হিসাব করে রোগীপ্রতি মোট কর্মঘণ্টা হয় ৭৩ দশমিক ৩ ডলার বা ৮ হাজার ৮৭০ টাকার মতো।

রাজধানীর মহানগর এলাকায় থাকেন রত্না মোজাহিদ। তিনি ডেঙ্গুর লক্ষণ নিয়ে গত ডিসেম্বরে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। এরপর চিকিৎসা শুরু হলেও শরীরে ব্যথা ও জ্বর কমছিল না। পরে পরীক্ষা করে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়। প্রায় এক মাস তিনি ভুগেছেন বলে জানান। প্রাথমিকভাবে রোগ নির্ণয় যেমন হয়নি, তাঁর ভোগান্তিও হয়েছে বিস্তার, বলেন তিনি।

নাজমুল হায়দার

চিকুনগুনিয়ার ‘ফাঁকা মাঠ’

২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত (করোনাসহ) ডেঙ্গুর দিকেই দৃষ্টি ছিল বেশি। এর মধ্যে ২০২৩ সালে দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুর সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাব হয়। ডেঙ্গু ভাইরাসের বেশ কয়েকটা বড় প্রাদুর্ভাব হওয়ার পর অনেক মানুষের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরোটাইপ–২ ও ৩–এর বিরুদ্ধে একধরনের ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে। তাই এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ অপেক্ষাকৃত কম হতে পারে বলে মনে করেন এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত যুক্তরাজ্যের কেইল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক নাজমুল হায়দার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের বিরাট একটা জনগোষ্ঠীর শরীরে চিকুনগুনিয়ার অ্যান্টিবডি নেই, তাই চিকুনগুনিয়ার বিস্তার অনেক সহজ হবে। সুতরাং আগামী দুই বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গুর পরিবর্তে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের রাজত্ব চলার আশঙ্কা আছে।

বৈশ্বিক সমস্যায় বাংলাদেশে বিপদের শঙ্কা

ডেঙ্গু এবং সেই সঙ্গে চিকুনগুনিয়ার রোগবাহী এডিস মশার দুটি প্রজাতি আছে—এডিস ইজিপটাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস। ২০০৬ সালে পর্যন্ত কেবল এডিস ইজিপটাইয়েরই চিকুনগুনিয়ার বিস্তারের ক্ষমতা ছিল, কিন্তু এর ব্যত্যয় দেখা দেয় ২০০৬ সালে। ওই বছর ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র ‘লা রিইউনিয়নে’ চিকুনগুনিয়ার একটা বড় প্রাদুর্ভাব হয়।

অবস্থা এত খারাপ হয় যে দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ অল্প সময়ের মধ্যে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়। যদিও সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দ্বীপরাষ্ট্রটির ৭ লাখ ৮৫ হাজার অধিবাসীর মধ্যে ২ লাখ ৬৬ হাজার আক্রান্ত হয়। অফিস-আদালতে কাজ করার মতো লোকজনের সংকট দেখা যায় এবং সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।

লা রিইউনিয়নে দেখা যায়, সেখানে প্রথমবারের মতো অ্যালবোপিকটাসও চিকুনগুনিয়া ছড়াচ্ছে। ইজিপটাইয়ের মাধ্যমে একজন রোগী থেকে যেখানে চারজন আক্রান্ত হতে পারে, সেখানে অ্যালবোপিকটাসের সংক্রমণ হার ২ দশমিক ৮।

বাংলাদেশে ২০১৯ সালের এক গবেষণায় আইইডিসিআর দেখায়, অ্যালবোপিকটাস ছড়াচ্ছে দ্রুত। যশোর, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরের পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়, গ্রামগঞ্জে অ্যালবোপিকটাস বেশি পরিমাণে ছড়িয়ে পড়ছে।

নাজমুল হায়দার বলছিলেন, বাংলাদেশের বিপদটাই এখানে। এখন গ্রামগঞ্জে অ্যালবোপিকটাসের বিস্তৃতি ব্যাপক। চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়তে এটি ভূমিকা রাখতে পারে।

ডা. মুশতাক হোসেন

ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে, সরকারের প্রস্তুতি কম

ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলতি বছর চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতির জটিলতায় গত এপ্রিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) একটি সভা করে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, এ বছর দক্ষিণ আমেরিকা ও ভারত মহাসাগরীয় বিভিন্ন দেশের চিকুনগুনিয়ার ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের কথা বলা হয় সভায়। যেহেতু বৈশ্বিক যোগাযোগব্যবস্থা এখন খুব উন্নত, তাই বাংলাদেশের মতো দেশে এর বড় সংক্রমণ ঘটা অস্বাভাবিক নয়। যেহেতু এডিস মশার বিস্তার এখনো যথেষ্ট ঘটছে।

গতকাল বুধবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ২৪০ জন। গত বছরের এ সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৭৯৫ জন। এরই মধ্যে সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেওয়া হয়েছে। শ্লথ হয়ে পড়েছে মশকনিধন কার্যক্রমও। এ ধরনের অবস্থায় চিকুনগুনিয়ার সম্ভাব্য প্রকোপ মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগ কী?

প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক হালিমুর রশিদ বলেন, ‘১৩ মে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোধে আমরা সভা করেছি। সেখানে সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আমাদের কথা বলেছি। আসলে মশার নিয়ন্ত্রণই এখন মূল বিষয়।’

দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়লেও সরকারি তৎপরতা যেমন নেই, তেমনি নেই কোনো প্রচার। হালিমুর রশিদ বলছিলেন, ‘প্রচারকাজ চালানোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থ হাতে নেই। ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে বিভিন্ন টেলিভিশনকে স্ক্রল প্রচারের অনুরোধ করেছিলাম। তারা অর্থ চেয়েছে। আমরা তা দিতে পারিনি। আমি তথ্য অধিদপ্তরকেও বলেছি, তারাও সচেষ্ট হয়নি।’