জয়িতার দ্বন্দ্ব মেটেনি, ফুডকোর্টে এসির ঠান্ডা নেই, উদ্যোক্তাদের হাঁসফাঁস

রাজধানীর ধানমন্ডির রাপা প্লাজায় জয়িতা বিপণনকেন্দ্রছবি: প্রথম আলো

বাইরে প্রখর রোদ। খাবারের খোঁজে রাপা প্লাজার কাচঘেরা জয়িতার ফুডকোর্টে ঢুকতেই আরেক দফা গরমের ধাক্কা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) কাজ করছে না। এরই মধ্যে ভিড়। বাতাস শীতল করতে চলছে স্ট্যান্ড ফ্যানের ব্যর্থ চেষ্টা। ৫ মে রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে রাপা প্লাজার পঞ্চম তলায় অবস্থিত জয়িতার ফুডকোর্টে গিয়ে এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে।

জয়িতা ফাউন্ডেশনের অধীনে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ১২ তলা ‘জয়িতা টাওয়ার’ নির্মাণ করা হয়েছে। নতুন টাওয়ারে সরাসরি স্থানান্তর চান উদ্যোক্তারা। সরকার চায় নতুন উদ্যোক্তা নিতে। এ নিয়ে দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব চলছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জয়িতা ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বিগত সরকারের ‘আশীর্বাদপুষ্ট’ উদ্যোক্তারা জয়িতাতে একতরফাভাবে ব্যবসা করছেন।

জয়িতার উদ্যোক্তারা বলছেন, আশপাশের রেস্তোরাঁর তুলনায় দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় জয়িতা ফুডকোর্টে ভিড় লেগে থাকে। তবে দুই মাস ধরে ফ্লোরে ১৬টি এসির কোনোটিই কাজ করছে না। ভাড়ায় আনা স্ট্যান্ড ফ্যান দিয়ে গরম কমানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিচালিত জয়িতা ফাউন্ডেশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ফাউন্ডেশন এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

তবে জয়িতা ফুডকোর্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আরিফুল হোসেন বলেন, এসিগুলো যে চলছে না, তা নয়। চালু আছে তবে ঠান্ডা বাতাস আসছে না। গত শীতের সময় থেকেই এমন পরিস্থিতি চলছে। সার্ভিসিং করালে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।

এদিকে মন্ত্রণালয় ও জয়িতা ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, উদ্যোক্তাদের কাছে স্টল ভাড়া বাবদ ৫৪ লাখ টাকা সরকারের পাওনা আছে। জয়িতা বাবদ মাসে সরকারের ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়। এই খরচ তাঁরা আর টানতে চান না। উদ্যোক্তারা একচেটিয়া ব্যবসার চক্র গড়ে তুলেছে দাবি করে ওই কর্মকর্তারা বলেন, এই চক্র ভেঙে সরকার এখন নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিতে জয়িতা টাওয়ার চালু করা নিয়ে কাজ করছে।

রাপা প্লাজায় জয়িতার ফুডকোর্ট
ছবি: প্রথম আলো

জানা গেছে, ৫ মাস ধরে জয়িতার বিপণনকেন্দ্র ও ফুডকোর্ট নিয়ে উদ্যোক্তা আর ফাউন্ডেশনের দ্বন্দ্ব চলছে। গত বছরের ডিসেম্বরে জয়িতা ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত রাপা প্লাজার চতুর্থ ও পঞ্চম তলার ভাড়া বজায় থাকবে। ১ এপ্রিল থেকে সেখানে জয়িতা ফাউন্ডেশনের আর কার্যক্রম পরিচালিত হবে না। ফ্লোর দুটি রাপা প্লাজা কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করা হবে। এর আগে ২৪ মার্চের মধ্যে ফ্লোর দুটি খালি করে দিতে উদ্যোক্তাদের জানুয়ারি মাসে দুই দফা চিঠি দেওয়া হয়। উদ্যোক্তারা এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করে এক মাসের স্থিতাবস্থার আদেশ পান। আদালতের স্থিতাবস্থা ১৬ এপ্রিল শেষ হওয়ার পর ওই দিন এবং পরে ১ মে রাপা প্লাজা ছাড়তে আবার চিঠি দেয় ফাউন্ডেশন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত এবং নতুন টাওয়ারে স্থানান্তর করা না পর্যন্ত রাপা প্লাজায় থাকার সুযোগ চেয়ে ৫ মে উচ্চ আদালতে আপিল করেন উদ্যোক্তারা।

সাড়া নেই ফাউন্ডেশনের

ফুডকোর্টের উদ্যোক্তা মোসা. আফসানা হক তুলি প্রথম আলোকে বলেন, রাপা প্লাজা ছাড়ার চিঠি দেওয়ার পর তাঁরা ফাউন্ডেশন থেকে আর কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না। গত দুই মাস ধরে ফুডকোর্টের সব এসি নষ্ট। অতিথি ও ক্রেতারা জয়িতা থেকে নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। নারীদের দুটি টয়লেটের একটি ব্যবহার অনুপযোগী। ৩টি বেসিনের মধ্যে ২টি বেসিনের কল নষ্ট—ইত্যাদি জানিয়ে প্রথমে গত ৯ এপ্রিল ও পরে ৩ মে তাঁরা জয়িতা ফাউন্ডেশনে চিঠি দিয়েছেন।

ক্ষোভ প্রকাশ করে এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘নষ্ট জিনিস ঠিক করার বিষয়ে ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে আমরা কোনো সাড়া পাচ্ছি না। গরম কমাতে মাসে ৪৮ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে ৮টি ফ্যান নিয়ে আসা হয়েছে। বিক্রিও কমে গেছে। আগে দিনে ২০ হাজার টাকার খাবার বিক্রি করতাম। এখন ২ হাজার ৫০০ টাকার বেশি বিক্রি করতে পারছি না।’

ফুডকোর্টে এসি নষ্ট থাকায় স্ট্যান্ড ফ্যান দিয়ে বাতাসের ব্যবস্থা করা হচ্ছে
ছবি: প্রথম আলো

রাপা প্লাজার চতুর্থ তলায় জয়িতার বিপণনকেন্দ্রের স্টলগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কিছু এসি চলছে। তবে কিছু বন্ধ। ২০১১ সাল থেকে ওই ফ্লোরে ঘর সাজানোর পণ্যের স্টল রয়েছে উদ্যোক্তা ফারহানা আরফিনের। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এই ফ্লোরে ১৬টি এসির মধ্যে ৪টি চলছে। আমার স্টল পেছন দিকে। সেখানে এসি নষ্ট থাকায় স্ট্যান্ড ফ্যান নিয়ে এসেছি।’

ফাউন্ডেশন-উদ্যোক্তার দ্বন্দ্ব

নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ২০১১ সালের নভেম্বরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জয়িতার যাত্রা শুরু হয়। এর ফাউন্ডেশন হয় ২০১৬ সালে। ফাউন্ডেশন দেশজুড়ে নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া, উদ্যোক্তাদের মধ্যে নেটওয়ার্ক তৈরি, পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রিতে সহায়তা করে।

জয়িতা বিপণনকেন্দ্রের ভেতরের দৃশ্য
ছবি: প্রথম আলো

জয়িতা ফাউন্ডেশনের অধীনে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ১৫৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১২ তলা ‘জয়িতা টাওয়ার’ নির্মাণ করা হয়েছে। ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর ভবনটির উদ্বোধন হলেও তা এখনো চালু হয়নি। শুধু দুটি ফ্লোরে ফাউন্ডেশনের কার্যালয় চালু হয়েছে।

জয়িতা টাওয়ার নির্মাণের পর থেকেই উদ্যোক্তাদের সঙ্গে ফাউন্ডেশনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। নতুন টাওয়ারে সরাসরি স্থানান্তর চান উদ্যোক্তারা। সরকার চায় নতুন উদ্যোক্তা নিতে।

রাপা প্লাজার চতুর্থ তলায় এখন জয়িতার বিপণনকেন্দ্রে ৭৮টি ও ফুডকোর্টের জন্য ১৬টিসহ মোট ৯৪টি স্টল আছে। সমিতির অধীনে সেখানে স্টল বরাদ্দ নিতে হয় নারীদের। উদ্যোক্তাদের স্টল প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা ভাড়া ফাউন্ডেশনকে দেওয়ার নিয়ম আছে।

নতুন টাওয়ারে স্টল চান উদ্যোক্তারা, সরকারের আপত্তি

জয়িতার উদ্যোক্তারা বলেন, ভবনটি নির্মাণের আগে তাঁদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেখানে তাঁদের স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু ২০২৪ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এক কর্মশালায় তাঁদের জানানো হয়, নতুন ভবনে তাঁরা সরাসরি ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন না। শুধু উৎপাদক হিসেবে পণ্য সরবরাহ করতে পারবেন। সেই পণ্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (আড়াই থেকে তিন মাস) বিক্রি না হলে তাঁদের ফেরত দেওয়া হবে।

নীলফামারীর ‘লাকি মহিলা উন্নয়ন সমিতি’র হয়ে ২০১৩ সালে স্টল বরাদ্দ পেয়েছিলেন শাহনাজ বেগম। তাঁর নারীদের পোশাক ও ঘর সাজানো পণ্যের স্টল। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা উৎপাদক হিসেবে নয়, সরাসরি ব্যবসা করতে চেয়েছি। এখন সরকার নতুন টাওয়ারে নেওয়ার ব্যবস্থা না করে আমাদের রাপা প্লাজা ছেড়ে দিতে দফায় দফায় চিঠি দিচ্ছে।’

ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ১২ তলা ‘জয়িতা টাওয়ার’
ছবি: প্রথম আলো

ফারহানা আফরিন, নার্গিস মাসুদ, মোসা. আফসানা হক তুলিসহ কয়েকজন উদ্যোক্তা বলেন, তাঁরা নতুন টাওয়ারে স্থানান্তরিত হতে চান। সরাসরি ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি করতে চান।

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জয়িতা ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, বিগত সরকারের ‘আশীর্বাদপুষ্ট’ উদ্যোক্তারা জয়িতাতে একতরফাভাবে ব্যবসা করছেন। অনেকে স্টল নিয়ে অন্যজনের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। তাঁদের সব পণ্যের মানও ভালো নয়। গত ১৩ বছরে এই উদ্যোক্তাদের পেছনে সরকারের ৪২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এখন সরকার চায়, তৃণমূল থেকে যোগ্য নারীরা যেন তাঁদের পণ্য জয়িতাকে দিতে পারেন। কাউকে আলাদা করে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হবে না।

স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউরের (এসওপি) মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে উদ্যোক্তাদের পণ্য নেওয়া হবে। জয়িতা যেন আড়ং বা ইউনিমার্টের মতো রপ্তানিযোগ্য মানের পণ্য বিক্রি করতে পারে। পুরোনো উদ্যোক্তাদের পণ্য নেওয়া হবে না, সেটা বলা হয়নি। কিন্তু তাঁরা কোনো প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যেতে চান না। একচেটিয়া ব্যবসা করতে চান। তাঁরা চরম অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন।

ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, সরকার জয়িতার বিদ্যুৎ বিল ও স্টল পরিচালনার খরচ বহন করে। সরকারকে স্টলপ্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে ভাড়া দেওয়ার কথা, কিন্তু সেই ভাড়াও তাঁরা দেন না। উদ্যোক্তাদের কাছে ভাড়া বাবদ সরকারের পাওনা আছে ৫৪ লাখ টাকা।

উদ্যোক্তা শাহনাজ বেগম বলেন, ভাড়া দুই মাস বকেয়া থাকলে স্টলের বরাদ্দ বাতিলের নিয়ম আছে। ফাউন্ডেশন শুরু থেকে সেই নিয়ম কার্যকর করলে এত টাকা বকেয়া হতো না। নতুন উদ্যোক্তাদের জায়গা দেওয়ার বিষয়ে তাঁদের কোনো আপত্তি নেই।

আরও পড়ুন