ঢাকা দখলের লড়াই

১৯৭১ সালে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ ডিসেম্বর মাসে দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। বিজয়ের এই মাসে আমরা হাজির করছি তারিখ ধরে ধরে সেই দিনগুলোর ঘটনাধারা। ঈষৎ সংক্ষেপ করে লেখাটি নেওয়া হয়েছে প্রথমা প্রকাশনের প্রকাশিতব্য বই একাত্তরের দিনপঞ্জি: মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি থেকে।

ইন্দিরা গান্ধী ও রিচার্ড নিক্সন

মুক্তিসংগ্রামের এই পর্যায়ে ১২ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা দখলের লড়াই শুরু হয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকা কার্যত মুক্ত। ভৈরব বাজার থেকে যৌথ বাহিনী এদিন নরসিংদীতে এসে পৌঁছায়। আগের দিন যারা ময়মনসিংহ দখল করেছিল, তারাও ক্রমেই ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে হেলিকপ্টারে অবতরণকারী সেনা। হেলিকপ্টার এসেছে মেঘনা ও যমুনা দ্রুত পার হয়ে যেতে। যৌথ বাহিনীর বেশ কয়েকটি দল ঢাকামুখী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নানা স্থানে যৌথ বাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ করলেও মোটেই রুখতে পারেনি।

যৌথ বাহিনীর একটি অংশ খুলনার উপকণ্ঠে পৌঁছায়। হিলি থেকে এগিয়ে তারা বগুড়া শহর থেকে ১০ মাইল দূরে অবস্থান নেয়। বগুড়ার পতন আসন্ন। চট্টগ্রামেও পাকিস্তানি বাহিনী ছত্রভঙ্গ। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও পাকিস্তানি ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমানবাহিনী ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে। রাঙামাটিতে ছত্রভঙ্গ পাকিস্তানি সেনারা মিয়ানমারের দিকে পালাতে থাকে।

নিক্সনের অপচেষ্টা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এদিন পাকিস্তানের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানান। যুদ্ধ সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে নিরাপত্তা পরিষদে নতুন বৈঠক ডাকারও অনুরোধ জানান। নিক্সন নিরাপত্তা পরিষদের উদ্দেশে বলেন, এই লড়াই থামানোর জন্য জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে। পূর্ব বাংলা ভারতীয় সেনারা প্রায় দখল করে নিয়েছে।

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র রোনাল্ড জিগলার এক বিবৃতিতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভারতের এই আক্রমণ জাতিসংঘের একটি সদস্যরাষ্ট্রের ওপরই আক্রমণ। বিষয়টি অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদে আনার জন্য নিক্সন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশকে নির্দেশ পাঠিয়েছেন।

আজ সকালে তিনি কিসিঞ্জারের সঙ্গে আলোচনা করে সে অনুযায়ীই অগ্রসর হচ্ছেন।

এদিন রাতে নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক ডাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জোর চেষ্টা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ডের জোরালো দাবির মুখে তা স্থগিত হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকে চীন সমর্থন জানিয়েছিল। অবশেষে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি ১৩ ডিসেম্বর আবার বৈঠক শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়।

ইন্দিরার সাবধানবাণী

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে এক জনসভায় চলমান ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক চুক্তি যেন কাজে লাগানোর চেষ্টা না করা হয়।

ইন্দিরা গান্ধী এদিন জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, পাকিস্তান পূর্ববঙ্গ থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করলে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি যাদের আনুগত্য রয়েছে, তাদের সঙ্গে আপসরফা করে, তাহলে তিনি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বিবেচনা করতে রাজি আছেন।

নুরুল আমিনের তৎপরতা

নুরুল আমিন এদিন ইসলামাবাদে পাকিস্তানে নিয়োজিত চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেন। উপমহাদেশে যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে চীনা সরকারকে জানাতে তিনি চীনা রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ জানান। নুরুল আমিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেন।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ১৩–১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, পৃ. ১৪৯