সরকারব্যবস্থায় কেন্দ্রের আধিপত্য ও প্রান্তের নীরবতা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতির সামনে প্রধান প্রশ্নটা কে ক্ষমতায় আসবে তা নয়, বরং রাষ্ট্রের কাঠামো কেমন হবে—এই প্রশ্নই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে ক্ষমতার ভারসাম্য এত দিন ঢাকার কেন্দ্রভূমিতে আটকে ছিল, এখন সেটিকে নতুনভাবে কল্পনা করার সময় এসেছে। 

কেমন হবে সেই নতুন কাঠামো? সেখানে কেন্দ্র ও প্রান্তের সম্পর্ক কীভাবে পুনর্গঠিত হবে? এই কাঠামোয় সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে প্রান্তিক ও গ্রামীণ জনগণ, কীভাবে নিজের অভিজ্ঞতা, প্রয়োজন ও চাহিদার জন্য জায়গা তৈরি করবে? গণতন্ত্র যদি কেবল ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জীবনের প্রতিদিনের বাস্তবতায় প্রভাব ফেলতে চায়, তবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই হবে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থার মৌলিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে এই প্রশ্নগুলোর যৌক্তিক উত্তর খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

নামেই বিকেন্দ্রীকরণ

বাংলাদেশের উন্নয়ন–কাহিনি প্রায়ই কেন্দ্রের সাফল্যের গল্পে আটকে থাকে। ঢাকামুখী অর্থনীতি, নীতি, প্রশাসন ও ক্ষমতার একচেটিয়া প্রবাহই এ দেশের রাজনীতির স্থায়ী বৈশিষ্ট্য। এই কাঠামোতে গ্রাম, উপজেলা, ইউনিয়ন থাকে সিদ্ধান্তের বাইরে। বস্তুত বাংলাদেশে কেন্দ্র ও প্রান্তের মধ্যকার প্রকট বৈষম্য টিকে আছে কেন্দ্রের তুলনায় ক্ষমতাহীন এবং কেন্দ্রের ওপরে নির্ভরশীল বৈষম্যমূলক স্থানীয় সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে। 

বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা একধরনের ঐতিহাসিক বৈষম্যের মধ্যে গড়ে উঠেছে। এটি নামেই ‘বিকেন্দ্রীকৃত’, বাস্তবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ ছায়ায় আবদ্ধ। গ্রামীণ ইউনিয়ন পরিষদ, যা সবচেয়ে পুরোনো ও জনগণের সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠান—আজ কার্যত মন্ত্রণালয়ের এক্সটেনশন অফিস। তাদের বাজেট, প্রকল্প, এমনকি কর্মচারী নিয়োগও নির্ধারিত হয় ঢাকায়। 

শহরের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা ভোগ করে এবং তাদের সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়িত হয়। কারণ, তারা কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কের অংশ। উদাহরণস্বরূপ—ঢাকায় একজন নাগরিকের জন্য যে পরিমাণ রাজস্ব ব্যয় হয়, তা একটি গ্রামীণ ইউনিয়ন পরিষদের মানুষের জন্য ব্যয়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি। অথচ এখনো প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ বাস করে গ্রামে, যেখানে সন্তানের জন্মনিবন্ধন থেকে শুরু করে বয়স্ক ভাতা বা আশ্রয় প্রকল্প—সবকিছুতেই ইউনিয়ন পরিষদের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদের হাতে বাজেট, কর্মী, প্রযুক্তি বা নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে।

এই কাঠামো কেবল প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতারও প্রতিফলন, যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কিছু গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত, প্রান্তিক মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও চাহিদা রয়ে যায় প্রান্তেই। 

উপজেলা, ইউনিয়ন ও জেলা পরিষদের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হলেও তাঁদের বাস্তব ক্ষমতা সীমিত। বাজেট, উন্নয়ন প্রকল্প বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের চাবিকাঠি থাকে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের হাতে। ফলে প্রান্তিক জনগণ স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে নিজেদের প্রয়োজন ও অভিজ্ঞতা রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রতিফলিত করতে পারেন না। এ কারণেই উন্নয়ন পরিকল্পনা অনেক সময় মানুষের বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না; যেখানে রাস্তা আছে, সেখানে আবার রাস্তা হয়, আর যেখানে বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ দরকার, সেখানে বরাদ্দ মেলে না।

রাজনৈতিক অর্থনীতির বাস্তবতা

এই অন্যায্য ও অসম কাঠামো কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়; বরং একটি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিন্যাস, যেখানে ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব কিছু এলিট গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত। নয়া মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণে রাষ্ট্রকে দেখা হয় এলিট শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী যন্ত্র হিসেবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই শ্রেণি কেবল অর্থনৈতিক নয়, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকও বটে, যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বণ্টনের নিয়ম নির্ধারণ করে। 

কেন্দ্রীকৃত কাঠামো মানে ক্ষমতা সীমিত মানুষের হাতে। সিদ্ধান্ত হয় ঢাকায়, কিন্তু তার প্রভাব পড়ে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের জীবনে। এই ‘এলিট ক্যাপচার’–এর ফলে স্থানীয় মানুষ, বিশেষ করে নারী, দরিদ্র ও প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো নীতিনির্ধারণ থেকে ছিটকে যায়। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও জেলা পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে যেসব প্রতিনিধিত্বমূলক কাঠামো তৈরি হয়, তা প্রকৃত অর্থে অংশগ্রহণমূলক হতে পারে না। কারণ, সিদ্ধান্তের বাস্তব ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। ফলে গণতন্ত্র কেবল ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, নাগরিক অংশগ্রহণ হয়ে যায় প্রতীকী। স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক জীবনে যে নৈরাজ্য, দুর্নীতি বা হীনম্মন্যতা দেখা যায়, তা এই কাঠামোগত অক্ষমতারই প্রতিফলন। 

এখন প্রশ্ন হলো কেন এই অসম কাঠামো এত দিন টিকে আছে? উত্তর লুকিয়ে আছে রাজনৈতিক অর্থনীতির যুক্তিতে। কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ও সম্পদ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি পারস্পরিক নির্ভরতার চক্র তৈরি হয়েছে। রাজনীতিকেরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান প্রশাসন ও সম্পদ, আমলারা চান নীতি ও প্রক্রিয়ার মালিকানা। উভয় পক্ষই এই কেন্দ্রীকরণ থেকে লাভবান। কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রশাসনের জন্য এই বৈষম্য আসলে একটি ‘ইনসেনটিভ স্ট্রাকচার’ এবং এখানেই নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ, প্রকল্প ও সম্পদ বণ্টনের সুযোগ। বিকেন্দ্রীকরণ মানে এই নিয়ন্ত্রণ হারানো। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর স্বার্থ এই কেন্দ্রীভূত কাঠামো টিকিয়ে রাখার মধ্যেই নিহিত। ফলে সংস্কারের প্রস্তাব যতই থাকুক, বাস্তবায়িত হয় না। বাস্তবে বিকেন্দ্রীকরণ মানে রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র ও অর্থনৈতিক অভিজাত শ্রেণির মধ্যকার স্বার্থের শৃঙ্খল ভাঙা। তা সম্ভব হয়নি। এটাই স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কারের মূল রাজনৈতিক বাধা।

প্রান্তিক মানুষের সেবা পাওয়ার কথা ইউনিয়ন পরিষদে। বরিশাল সদরের শায়েস্তাবাদ ইউপি কার্যালয়
ছবি: প্রথম আলো

সংস্কার কেন জরুরি

এই বৈষম্যের ফল শুধু প্রশাসনিক দুর্বলতা নয়, এটি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সংকোচনও ঘটায়। যখন মানুষ দেখে তাদের প্রতিনিধি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, তখন তাদের অংশগ্রহণের আগ্রহ হারিয়ে যায়। গণতন্ত্র তখন পরিণত হয় একধরনের ওপর-নিচের সম্পর্কের খেলায়, যেখানে সাধারণ নাগরিক হয়ে যান দর্শক, অংশগ্রহণকারী নন। 

তাই নতুন বাংলাদেশ নিয়ে যে রাজনৈতিক কল্পনা তৈরি হচ্ছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে হবে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সংস্কার। কেবল প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন নয়, ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের প্রক্রিয়া, যেখানে কেন্দ্রের নয়, প্রান্তিক মানুষের অভিজ্ঞতা ও চাহিদা হবে রাষ্ট্রনীতির প্রারম্ভিক বিন্দু। 

সংস্কার মানে, প্রথমত, আর্থিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজস্ব রাজস্ব আহরণের ক্ষমতা ও উন্নয়ন বাজেটে সরাসরি প্রবেশাধিকার দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ—উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে হবে নির্বাচিত পরিষদের কাছে, বিপরীত নয়। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রসার—যেখানে নাগরিকেরা বাজেট–প্রক্রিয়া, পরিকল্পনা ও তদারকিতে সরাসরি যুক্ত থাকবেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আন্তরিকতা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্ত কেন্দ্র-প্রান্ত বৈষম্যের দিকটি নতুন করে সামনে এনেছে। উদাহরণস্বরূপ, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা হঠাৎ বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এসেছে এমন সময়ে, যখন বন্দর কার্যক্রমে বড় কোনো অভিযোগ ছিল না। এ ধরনের সিদ্ধান্তে স্থানীয় বা জাতীয় কোনো পরামর্শপ্রক্রিয়া দেখা যায়নি। আবার পুলিশের সংস্কার, স্থানীয় সরকার কমিশনসহ নানা সংস্কার কমিশনের শতাধিক বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ আজও অন্ধকারে পড়ে আছে। প্রশ্ন জাগে—এই বিলম্ব কি কেবল প্রশাসনিক জটিলতা, নাকি কোনো অদৃশ্য স্বার্থগোষ্ঠীর নীরব প্রতিরোধ?

নতুন রাজনৈতিক কল্পনা: বিকেন্দ্রীকরণের পথ

গণ-অভ্যুত্থানের পর ‘নতুন বাংলাদেশ’ নিয়ে যে জনকল্পনা তৈরি হয়েছে, তার বাস্তব ভিত্তি গড়ে তুলতে হলে বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া পথ নেই। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাগুলোর আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা বাড়াতে হবে। স্থানীয়ভাবে কর আদায়ের ক্ষমতা, প্রকল্প নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ, স্থানীয় বাজেটের স্বচ্ছতা ও নারী নেতৃত্বের সুযোগ—এসবকে কেন্দ্র করে একটি নতুন সামাজিক চুক্তি তৈরি করতে হবে।

কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা হতে হবে নীতিনির্ধারণ ও সহায়তার, নিয়ন্ত্রণের নয়। স্থানীয় প্রশাসনকে রাজনৈতিকভাবে জবাবদিহিমূলক ও অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম করে তুলতে না পারলে গণতন্ত্র কেবল রাজধানীমুখী আড়ম্বর হয়ে থাকবে। গণ-অভ্যুত্থান আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, গণতন্ত্রের আসল মাপকাঠি রাজধানীর রাজনীতি নয়, বরং প্রান্তের মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনা। রাষ্ট্রের শক্তি তখনই টেকসই হয়, যখন সিদ্ধান্ত ও সম্পদ বিতরণে সমতা থাকে। তাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার পরবর্তী ধাপ হতে পারে একটি অংশগ্রহণমূলক বিকেন্দ্রীকরণ, যেখানে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত প্রত্যেক নাগরিক অনুভব করবেন, রাষ্ট্র তাঁর নিজের। 

কেন্দ্র ও প্রান্তের ব্যবধান ঘোচাতে স্থানীয় সরকার সংস্কার কেবল প্রশাসনিক কাজ নয়; এটি নতুন বাংলাদেশের রাজনৈতিক কল্পনার বাস্তব রূপরেখা হতে পারে, যেখানে উন্নয়ন ও গণতন্ত্র উভয়ই নিচু স্তর থেকে ওপরের দিকে গড়ে উঠবে।

কাজী মারুফুল ইসলাম

অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়