‘কতক্ষণ প্রাণে বাঁচবেন’, তা নিয়েই ভাবনা ইউক্রেনে থাকা বাংলাদেশিদের
ইউক্রেনে রুশ হামলার পর এবার তৃতীয়বারের মতো সেখানে ঈদুল আজহা পালন করলেন মো. আবদুল জব্বার। তাঁর গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বাজারে। ইউক্রেনে রুশ হামলার পর তাঁর সঙ্গে অনেকবার কথা হয়েছে। তিনি থাকেন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের একেবারে কেন্দ্রস্থলে, দেশটির পার্লামেন্ট ভবনের কাছে। গত তিন বছরে, বিশেষ করে ঈদের দিনটায় রাজধানী কিয়েভ বা অন্যত্র থাকা বাংলাদেশিরা কেমন করে ঈদ করছেন, তা জানতেই জব্বারসহ অনেকের সঙ্গেই আগে কথা হয়েছে। আজ শনিবারও কথা বললাম। ইউক্রেনে অবশ্য গতকাল শুক্রবার পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্যাপিত হয়েছে।
যুদ্ধের মধ্যে থাকা দেশটিতে ঈদের আনন্দ ম্রিয়মান ছিল বরাবরই। কিন্তু এবারের মতো অবস্থা আগে হয়নি, এমনটাই বলছিলেন জব্বার। এর কারণ প্রসঙ্গে জব্বার বলছিলেন, ‘শহরে টেকা যাইতেছে না। একটু পরপর সাইরেন বাজে। বিস্ফোরণের শব্দ সবখানে। কোথায় পড়তেছে বোমা, কারা মরে যাইতেছ, বোঝা যায় না। যুদ্ধের পর এমন অবস্থা দেখিনি।’
প্রায় সাত দিন ধরেই ইউক্রেন এবং সেই সঙ্গে কিয়েভে বিস্ফোরণ বাড়ছে, এমন কথা জানালেন সেখানে বাংলাদেশিদের কয়েকজন। বৃহস্পতিবার রাতটা প্রায় পুরোটাই নির্ঘুম কাটিয়েছিলেন জব্বার ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। তার পরদিন ঈদ মোটেও ভালো কাটেনি তাঁর। নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন কাছের মসজিদে। কোরবানি করার কথা ছিল বাসা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের বরিসপিল বিমানবন্দরের কাছের একটি এলাকায়, কিন্তু পারেননি। কারণ জানতে চাইলে জব্বার বলছিলেন, ‘সেখানে বেশির ভাগ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ওই এলাকায় যাওয়ার পথে যদি কোনো ঝামেলা হয়, সেই ভয়েই আর যাইনি। এই প্রথম কোরবানির দিন কোরবানি দিতে পারলাম না। অথচ গরুর অভাব নেই। কিন্তু নিরাপত্তার অভাব এখন প্রকট।’
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরু হয়। এরপর দেশটির রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে থাকা বাংলাদেশিদের অনেকেই চলে যান। তবে এখন পর্যন্ত জব্বারের মতো কেউ কেউ আছেন। যাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই দেশটিতে আছেন দুই থেকে তিন দশক ধরে। সেখানেই বিয়েথা করে থিতু হয়েছেন। সুন্দর জীবনের সন্ধানেই ছিল এই বিদেশযাত্রা। সবকিছু ভালোই চলছিল। তারপর যুদ্ধের ইউক্রেন তাঁদের জীবনে বিপর্যয় নিয়ে এল। ঈদের মতো আনন্দের দিনগুলোও এখন আর আগের মতো নেই। এবার সেই ঈদের দিন পরিণত হয়েছে ‘ভয়ানক’ দিনে, বলছিলেন কিয়েভের নিপ্রোস্কি এলাকার বাসিন্দা মো. হাবিবুর রহমান। তাঁর গ্রামের বাড়ি গাজীপুরে।
এখনকার কিয়েভের পরিস্থিতি নিয়ে হাবিব বলছিলেন, ‘যখন-তখন মর্টার আইসা পড়ে। সাইরেনের শব্দে এখন মেট্রোতে বা বেজমেন্টে এত লোক হয় যে সেখানে জায়গা হইতে চায় না। গাদাগাদি করে লোক থাকে। এমন দিনও গ্যাছে যে ১০ বার সাইরেনের শব্দে লুকাতে হইছে। এর মধ্যে কোরবানি ক্যামন কইর্যা হয় বলেন? জীবন কতক্ষণ থাকবে, সেই নিয়াই ভাবনা।’
হাবিব জীবেনর যে এত ভয় পাচ্ছেন, এর পেছনে অবশ্য ভিন্ন কারণ আছে। তাঁর ২৪ বছরের ছেলেটিকে বাধ্যতামূলকভাবে যুদ্ধে যেতে হয়েছিল। সে অবশ্য গুলি খাওয়ার পর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসে। কিন্তু তাঁকে আবার যেতে হবে। এখন শুধু ছেলে একা নন, হাবিবকেও যুদ্ধে যেতে হতে পারে। এ জন্য একাধিকবার ফিটনেসের পরীক্ষা দিয়েছেন। রক্তের পরীক্ষা হয়েছে। কয়েক দফায় হাসপাতালে গিয়ে সেই পরীক্ষা করিয়ে এসেছেন।
হাবিবের কথা, ‘যেকোনো দিন ডাক আসতে পারে। যুদ্ধে যাওয়া লাগতে পারে। তবে এখনই জীবনের নিশ্চয়তা কোথায়? রাস্তাঘাটে যেকোনো স্থানে মইর্যা পড়ে থাকতে পারি। যে যুদ্ধ শুরু হইছে।’
শুক্রবার ঈদের দিনে কাছের মসজিদে নামাজ পড়েছেন হাবিব। সঙ্গে আর চার বাংলাদেশি ছিলেন। এ ছাড়া তাজিকিস্তান, পাকিস্তান, কিরগিজস্তানের কয়েকজন ছিলেন। আগে মসজিদে নামাজ পড়ে বাংলাদেশিদের বাড়িতে যাওয়ার রীতি ছিল। এখন আর তা নেই বলেই জানান হাবিব।
২ জুন রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলে চারটি সামরিক ঘাঁটিতে বড় ধরনের ড্রোন হামলা চালায় ইউক্রেন। এতে রাশিয়ার ৪০টির বেশি যুদ্ধবিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করেছেন ইউক্রেনের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা। তবে হামলায় ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি স্বাধীনভাবে যাচাই করেনি কোনো সংবাদমাধ্যম। কিন্তু কিয়েভের দাবি সত্য হয়ে থাকলে, তিন বছর আগে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার ভেতরে এটাই ইউক্রেনের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ড্রোন হামলা।
এই হামলার পাল্টা হিসেবে রাশিয়াও শত্রুদেশ ইউক্রেনে জোর হামলা শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার থেকে এ হামলা জোরদার হয়। গতকাল শুক্রবার ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ড্রোন হামলায় অন্তত ৩ জন নিহত এবং আরও ২১ জন আহত হয়েছেন।
কিয়েভে থাকা বাংলাদেশিদের সংশয়, এ হামলা আরও জোরদার হতে পারে। হাবিব বলছিলেন, ‘তিন বছরে এত বিস্ফোরণের শব্দ শুনিনি।’
হাবিব জানান, হামলা যত বেড়েছে, তত বেড়েছে মানুষের ওপর নজরদারি। কিয়েভ থেকে কোনো স্থাপনার ছবি বাইরে পাঠানো নিষেধ করেছে কর্তৃপক্ষ। তাদের বলা হয়েছে, এসব ছবি রাশিয়ার কাছে চলে যায়। তারা সেগুলো দেখে নাকি হামলার লক্ষ্য ঠিক করে।
এ পরিস্থিতির মধ্যে অবশ্য মানিয়ে নেওয়াকেই গ্রাহ্য বলে মনে করেন হাসিনুর রহমান। তাঁর বাড়ি বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গায়। এবার ঈদের মধ্যে স্থানীয় মসজিদে নামাজ আদায় এবং কোরবানিও করেছেন তিনি।
হাসিনুর বলছিলেন, ‘পরিস্থিতি জটিল হয়ে গেছে। কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে এটাই তো বাস্তবতা। পরিস্থিতি খারাপ হবে, আবার ভালো হবে। তবে এবার হয়তো দীর্ঘ সময় ধরে ঝামেলা হতে পারে।’
পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে দৃঢ় ইচ্ছার কথা জানালেন হাসিনুর। তবে তিনি যুদ্ধ-পূর্বের ঈদগুলোর স্মৃতি ভুলতে পারেন না। সেই সব দিনের সঙ্গে এখন আকাশ-পাতাল তফাত। হাসিনুর বললেন, ‘সেই সব দিনে আর ফিরে যেতে পারব কি না, কে জানে। তবে আশা নিয়ে থাকি।’