সরকার, শিল্প, একাডেমিয়ার যৌথ প্রচেষ্টায় হবে স্মার্ট বাংলাদেশ

টেকসই বিশ্বের জন্য প্রকৌশলগত সমাধান নিয়ে এক প্যানেল আলোচনায় দেশের প্রকৌশল অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরাছবি: প্রথম আলো

যেকোনো নির্মাণকাজেই শক্তি নিঃসরণ হয়। পৃথিবীতে ভবন নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত নিঃসরণই ৩৯ শতাংশ একটি নির্মাণ টেকসই হওয়ার জন্য তা পরিবেশবান্ধব হতে হয়। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারলে প্রাত্যহিক সমস্যার সমাধানগুলো অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব হবে। সরকারের উচিত এক হাতে শিল্প এবং আরেক হাতে একাডেমিয়াকে নিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কাউন্সিল ভবনে এক প্যানেল আলোচনায় দেশের প্রকৌশল অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন। আগামী ৪ মার্চ বিশ্ব প্রকৌশল দিবস সামনে রেখে টেকসই বিশ্বের জন্য প্রকৌশলগত সমাধান নিয়ে এ আলোচনার আয়োজন করা হয়। বুয়েট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় যৌথভাবে এই আলোচনার আয়োজন করে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড ও প্রথম আলো। আলোচনার উদ্বোধন করেন বুয়েটের উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশিষ্ট স্থপতি ও নেদারল্যান্ডসের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেরিনা তাবাশ্যুম বলেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানো পুরো বিশ্বের একটা বড় চিন্তা। আরেকটা উদ্বেগ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সংকট। আমাদের দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ইতিমধ্যে এটা দৃশ্যমান। স্থাপত্য সব সময়ই আমাদের জলবায়ু মাথায় রেখে ও স্থানীয় নির্মাণসামগ্রী দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু বিশ্বায়নের মাধ্যমে এর পশ্চিমা আদর্শ দাঁড় করানোর যে চেষ্টা করেছি, সেটি সব সময় সঠিক ছিল না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের গবেষণা করে এমন বাড়ি বানাতে হবে যেন বাস্তুচ্যুত মানুষ সেটি সহজে স্থানান্তর করতে পারে। নতুন নির্মাণসামগ্রীও বানাতে হবে।’

আলোচনায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী আলি আখতার হোসেন বলেন, ‘দুটি লক্ষ্য নিয়ে এলজিইডি কাজ করে—গ্রামীণ জনসাধারণকে সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং তাঁরা যাতে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে পারেন, তার জন্য বিপণনব্যবস্থা তৈরি করা। আমাদের রাস্তাঘাট যথেষ্ট হয়েছে। এখন কৃষিজমি বাঁচাতে হবে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বসতি এক জায়গায় নিয়ে আসা দরকার। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা “আমার গ্রাম, আমার শহরের” মাধ্যমে গ্রামীণ হাটবাজারগুলোকে কেন্দ্র করে টাউনশিপ ডেভেলপমেন্টের পরিকল্পনা নিচ্ছি; যাতে আর বিস্তৃত জনবসতি না হয় এবং নতুন ফসলি জমি নষ্ট না হয়।’

সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় পরিবর্তন দরকার বলে মনে করেন আলি আখতার হোসেন। তিনি বলেন, প্রকল্প যদি সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা যায়, প্রকল্পের নকশা যদি সেভাবে হয়, তাহলে বাড়তি কোনো সংশোধন প্রয়োজন হয় না৷ এতে প্রকল্পের সুফলও মানুষ পূর্ণাঙ্গভাবে পাবে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘যানজট, বায়ুদূষণ ও জলজট ঢাকায় আমাদের নিত্যসঙ্গী এখানে মূল চ্যালেঞ্জ হলো জায়গার ব্যবস্থাপনাটা আমরা ঠিকভাবে করতে পারছি কি না। পৃথিবীর বহু দেশে উন্নয়ন হয় গাইডেড; কিন্তু আমাদের দেশে আগে উন্নয়ন হয়, তারপর অবকাঠামোকে আমরা গাইড করি। এই জায়গাটা আমাদের মূল সমস্যা। তাই সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) আমরা সব মানুষের জন্য একটা ইনক্লুসিভ পরিকল্পনা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

আলোচনায় বুয়েটের সহ–উপাচার্য আবদুল জব্বার খান বলেন, একটা নির্মাণ কতটা পরিবেশবান্ধব, তার সঙ্গে টেকসই হওয়ার বিষয়টি সরাসরি যুক্ত। খরচ কমাতে গিয়ে এটা যেন হাই মেইনটেন্যান্স না হয়, সেটিও দেখতে হবে। ফলে এই চ্যালেঞ্জটা মাল্টিডিসিপ্লিনারি। বাজারে যেসব টেকসই নির্মাণসামগ্রী পাওয়া যায়, সেগুলো মাথায় রেখে নকশা করলে সাইট-স্পেসিফিক নিঃসরণের সমস্যাগুলো কমানো যাবে বলে তিনি মনে করেন।

সরকারি উন্নয়নপ্রক্রিয়া নিয়ে আবদুল জব্বার খান আরও বলেন, সরকারি ক্রয়বিধির (পিপিআর) একটা পূর্ণাঙ্গ সংশোধন দরকার একটা প্রকল্প প্রস্তাব কত বছরে অনুমোদিত হবে, সেটারও ধাপ ক্রমিক একটা গাইডলাইন দরকার। তা না হলে আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নের অনেক কিছুই অধরা থেকে যাবে।

রিহাবের সাবেক সভাপতি তানভীরুল হক বলেন, ঢাকার বাইরের লোকজনকে রিয়েল এস্টেট বোঝাতে কষ্ট হয়। লোকজন ঢাকায় আসতে চায়। সরকার যদি সবকিছুর বিকেন্দ্রীকরণের দিকে জোর দেয়, কিছু সংস্থার প্রধান কার্যালয় ঢাকার বাইরে নেয়, তখন লোকজন সেখানে থাকতে চাইবে।

লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেডের কমার্শিয়াল ডিরেক্টর অমিত আগারওয়াল বলেন, হোলসিম তাদের বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সবুজ উন্নয়নে কাজে লাগাতে চায়। এ জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের নানা উদ্যোগ তারা গ্রহণ করেন।

প্যানেল আলোচনায় সমাপনী বক্তব্যে বুয়েটের উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, ‘কোন ধরনের নির্মাণ ভবিষ্যতে টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও ব্যবহারোপযোগী হবে, তার জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন খুবই প্রয়োজন এটা সমন্বিতভাবে হওয়া দরকার। কীভাবে করলে কার্বন নিঃসরণ কম হবে, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে এবং আমাদের ঐতিহ্য নষ্ট হবে না, এসব দিক চিন্তা করেই আমাদের একটা সরকারি নীতি তৈরি করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভবনের নকশা ও ধরন পরিবর্তন করতে হবে৷ নির্মাণসামগ্রী, কার্বন নিঃসরণ ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা—সবকিছু নিয়েই ভাবতে হবে। শিল্প, একাডেমিয়া ও সরকারি নীতি, এ তিনটিকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকারের উচিত, এক হাতে শিল্প এবং আরেক হাতে একাডেমিয়াকে নিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক মুনির হাসান প্যানেল আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন প্যানেল আলোচনায় দর্শকদের নানা প্রশ্নেরও উত্তর দেন আলোচকেরা।