বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণ জানা যায়নি, বেড়েছে লোডশেডিং

বিদ্যুৎ না থাকায় গ্যাস দিতে পারছে না সিএনজি স্টেশনগুলো। তাই দিনের বেশির ভাগ সময় সিএনজি স্টেশনগুলো বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে কর্তৃপক্ষ। গতকাল বেলা আড়াইটায় রাজধানীর মগবাজারে একটি ফিলিং স্টেশনে
ছবি: সাজিদ হোসেন

বিদ্যুতের পূর্বাঞ্চল জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের পর এর সঙ্গে সংযুক্ত সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ধাপে ধাপে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনরায় চালু করতে দুই দিনের বেশি সময় লেগে গেছে। এতে দেশজুড়ে বেড়েছে লোডশেডিং।

বিদ্যুৎ বিভাগ ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, জুলাই থেকে শুরু হওয়া লোডশেডিংয়ের মাত্রা কিছুটা কমে এসেছিল। গ্রিড বিপর্যয়ের পর গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদার পুরোটা সরবরাহ করা যায়নি। তাই এক ঘণ্টার পরিবর্তে কোথাও কোথাও কয়েক ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে। ঢাকাতেও বেড়েছে লোডশেডিং।

আরও পড়ুন

পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, দুটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র গতকাল উৎপাদন শুরু করেছে। শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আর গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ জানতে তদন্ত কমিটি কাজ করছে।

গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ জানতে দুই দিন ধরে কাজ করছে পিজিসিবি গঠিত তদন্ত কমিটি। ইতিমধ্যে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অঞ্চল ঘোড়াশাল, আশুগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে।

আজ শুক্রবারের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। তবে তদন্ত কমিটির দুজন সদস্য প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আরও অনেক তথ্য লাগবে। বিপর্যয়ের সময় পশ্চিমাঞ্চল গ্রিড থেকে বাড়তি বিদ্যুৎ পূর্বাঞ্চলে সরবরাহের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে এখন। সব তথ্য পাওয়ার পর বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।

আরও পড়ুন

পিজিসিবির সাত সদস্যের তদন্ত কমিটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরী। তবে পিজিসিবির দায়িত্বশীল দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তথ্য বিশ্লেষণে মূল ভরসা তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী। তাঁর এ বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বেশি। গতকাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্য নিয়ে কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুল হাসিব চৌধুরী গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, কিছু ঘাটতি আছে, তাই আরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। দেরি করার ইচ্ছে নেই।

এদিকে গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ জানতে একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে গতকাল সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ভবিষ্যতে এমন বিপর্যয় এড়ানোর সুপারিশও করবে এ কমিটি। আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

তবে গ্রিড বিপর্যয় নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, গ্রিড বিপর্যয় অস্বাভাবিক বিষয় নয়। এমন কারিগরি ত্রুটি হতেই পারে। এ সময় উৎপাদনের চেয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালনে পিছিয়ে থাকার কথাও স্বীকার করেন তিনি।

কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন

জ্বালানি সাশ্রয়ে গত ১৯ জুলাই থেকে দেশে পরিকল্পিত লোডশেডিং শুরু করে সরকার। দিনে এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কথা থাকলেও তা মানা হয়নি শুরুতে। দিনে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি ঘাটতি ছিল বিদ্যুৎ সরবরাহে। তাই দেশের কোথাও কোথাও আট ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে। তবে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এটি কমে আসে।

গতকাল দিনের বেলায় দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার প্রাক্কলন ছিল ১১ হাজার ৬৫৪ মেগাওয়াট। সকাল ১০টায় ওই চাহিদার সময় সরবরাহ করা হয়েছে ৯ হাজার ৮২১ মেগাওয়াট। এতে ১ হাজার ৬৮৯ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে। দুপুর ১২টায় লোডশেডিং বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৬১ মেগাওয়াট। রাতেও একই হারে লোডশেডিং করতে হয়েছে বলে জানা গেছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র বলছে, গ্রিড বিপর্যয়ের পর ধাপে ধাপে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু করা হয়েছে। বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে বেসরকারি খাতের শীর্ষ বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপের মেঘনাঘাট ও বিবিয়ানা বন্ধ ছিল দুই দিন। এ দুটি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট। গতকাল এ দুটি কেন্দ্র আবার চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়া ১৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কেউ কেউ উৎপাদন বন্ধ রাখছে। আর গ্যাসের অভাবে অর্ধেকের বেশি উৎপাদন সক্ষমতা অলস পড়ে থাকে সব সময়।

পিডিবির সদস্য (কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স) মো. নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও উৎপাদন একটু কম হচ্ছে। গ্যাসের সংকট তো আছেই। আর গ্রিডে বিপর্যয়ের ধাক্কার পর বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে একটু সময় লাগে। দু-তিন দিনের মধ্যে অবস্থার উন্নতি হবে।

ঢাকায় তিন-চারবার লোডশেডিং

তিন দিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বারবার লোডশেডিংয়ে পড়ার অভিযোগ আসছে। এর মধ্যে মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা কামরুন্নেছা রুহী প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গলবার (গ্রিড বিপর্যয়ের দিন) টানা ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। এরপর দিনে তিন থেকে চারবার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। প্রতিবারই এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং থাকছে।

প্রায় একই অভিযোগ মিরপুরের বাসিন্দা প্রতিষ্ঠা বড়ুয়ার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিন দিন ধরে দিনরাত মিলিয়ে তিনবার করে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে।

ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)।

ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, দিনে ও রাতে ৪০০ মেগাওয়াটের বেশি ঘাটতি হচ্ছে। এতে প্রতিটি ফিডারে (নির্দিষ্ট গ্রাহক এলাকা) অন্তত দুবার, কোথাও তিনবার লোডশেডিং করতে হচ্ছে। আর ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির কাউসার আলী প্রথম আলোকে বলেন, লোডশেডিং সহনীয় হয়ে এসেছিল। এখন চাহিদার চেয়ে ২০০ মেগাওয়াট কম সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে। তাই এক ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের শিডিউল (সূচি) মানা যাচ্ছে না।

গ্রামেও খারাপ হয়েছে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি

ঢাকার বাইরে বিশেষ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) এলাকায় তিন মাস ধরেই বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিল। কিছুটা উন্নতি শুরু হতেই এখন আবার বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। দেশের প্রায় ৫৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে এ সংস্থা। সংস্থাটির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদার চেয়ে ১ হাজার ৩০০ থেকে ৪০০ মেগাওয়াট কম সরবরাহ হচ্ছে। এতে কয়েক ঘণ্টা করে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। ময়মনসিংহে ৩৫ শতাংশ ও সিলেটে ২০ শতাংশ লোডশেডিং করতে হয়েছে গতকাল।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চাহিদা কমার আশঙ্কা থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে সেপ্টেম্বরে লোডশেডিং কমার কথা বলা হয়েছিল। আদতে তা হয়নি। আগের চেয়ে বিদ্যুতের চাহিদা ইতিমধ্যে কমেছে। কিন্তু একই সঙ্গে আগের চেয়ে কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। তাই চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি কমছে না।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাড়তি লোডশেডিং। সক্ষমতা থাকলেও জ্বালানি খরচ কমাতে চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে না। শীত নামলে মানুষ স্বস্তি পেতে পারে। এটি হবে প্রকৃতির আশীর্বাদ; যেখানে সরকারের কোনো কৃতিত্ব নেই।