মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘সন্ত্রাস দমনের’ নামে যা করেছেন, সে জন্য তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে, তা তিনি বাংলাদেশে সশরীর উপস্থিত থাকুন বা না থাকুন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্কাই নিউজের এশিয়া প্রতিনিধি করডেলিয়া লিঞ্চকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। স্কাই নিউজের ওয়েবসাইটে আজ বুধবার সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসছবি: বাসস

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সরকারে থাকার সময় তাঁর তত্ত্বাবধানে মানুষকে জোরপূর্বক গুম করার পাশাপাশি গত বছর জুলাই ও আগস্ট মাসে বিক্ষোভকারীদের গণহারে হত্যা করা হয়।

স্কাই নিউজকে অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, ‘বিচারের ব্যবস্থা করা হবে। শুধু তাঁর নয়, বরং যাঁরা তাঁকে সহযোগিতা করেছেন, তাঁর পরিবারের সদস্য, তাঁর আশ্রিত ব্যক্তি অথবা সহযোগীদের, তাঁদের সবার বিচার করা হবে।’

আরও পড়ুন

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। বর্তমানে তিনি ভারতে আছেন। হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি গোপন বন্দিশালার একটি নেটওয়ার্কের তত্ত্বাবধান করতেন। সেখানে তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীদের জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন করা হতো, কাউকে কাউকে হত্যার অভিযোগও আছে। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে এসব করা হতো।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে দুটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তাঁরা ‘আনুষ্ঠানিক চিঠি’ পাঠিয়েছেন, কিন্তু নয়াদিল্লি থেকে এখনো ‘আনুষ্ঠানিক কোনো জবাব’ পাননি।

প্রধান উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেন, শেখ হাসিনাকে আদালতের মুখোমুখি করা হবে, তিনি সশরীর বাংলাদেশে উপস্থিত থাকুন বা না থাকুন।

অধ্যাপক ইউনূস সম্প্রতি গোপন বন্দিশালাগুলোর একটি পরিদর্শন করেছেন, যার কোড নাম দেওয়া হয়েছে ‘আয়নাঘর’। অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, তিনি সেখানকার দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেছেন।

আরও পড়ুন

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনি চোখে যা দেখতে পারেন, আপনি যা অনুভব করতে পারেন অথবা আপনার পক্ষে যা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব, তার মধ্যে সেগুলো সবচেয়ে জঘন্য।’

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, শত শত অ্যাকটিভিস্টকে (সক্রিয় কর্মী) অপহরণ, নির্যাতন এবং হত্যা করতে তিনি তাঁর নিরাপত্তা বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করেছেন। তবে হাসিনা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি রাজনৈতিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশে প্রায় ৮০০ গোপন বন্দিশালা আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা, তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং ওই সব বন্দিশালার তদারকিতে যাঁরা তাঁকে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের অনেকে বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।

অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, অপরাধের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিদের সংখ্যা এবং ব্যাপ্তির কারণে কাজ শুরু করতে ‘সময় লাগছে’।

এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তাঁদের প্রত্যেকে এর সঙ্গে জড়িত ছিল, পুরো সরকার এর সঙ্গে জড়িত ছিল। ফলে আসলে কারা এবং অতি উৎসাহী হয়ে কারা এই কাজ করেছে, কারা আদেশ পালন করতে গিয়ে এটা করেছে এবং কারা ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ওই সব কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন, তা আমরা প্রভেদ করতে পারছি না।’

আরও পড়ুন

শেখ হাসিনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং পুলিশের বিরুদ্ধেও জুলাই ও আগস্টের বিক্ষোভে দমন-পীড়নে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। জাতিসংঘের একটি হিসাব অনুযায়ী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত বিক্ষোভের দিনগুলোতে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

জুলাই-আগস্টে শহীদদের পরিবারগুলো কত দ্রুত ন্যায়বিচার পাবে এবং তাঁর আমলে ন্যায়বিচার পাবে কি না, তা ঘিরে যে প্রত্যাশার চাপ তৈরি হয়েছে, এটি পূরণের চেষ্টা করছেন অধ্যাপক ইউনূস।

চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ একটি নতুন সরকারের জন্য নির্বাচন আয়োজন করা হতে পারে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কেউ শাস্তি পাবেন, কিছু প্রক্রিয়া এখনো চলছে, কিছুর খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি।’

দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত

দেশের টালমাটাল এক অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তার পর থেকে তাঁকে অনেক কিছু সামলাতে হয়েছে এবং হচ্ছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তও এর মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে, তাঁদের একজন যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির আইনপ্রণেতা টিউলিপ সিদ্দিক। টিউলিপ শেখ হাসিনার বোনের মেয়ে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, ‘তাঁর বিরুদ্ধে মামলা গুরুতর। তাঁর বিরুদ্ধে বলা হয়েছে, তিনি বিপুল পরিমাণ সম্পদ এ দেশে রেখে গেছেন এবং এর সবকিছু খতিয়ে দেখা হবে।’
বাংলাদেশে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে—এমন খবরের পর টিউলিপ গত জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের জুনিয়র মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
টিউলিপের এক মুখপাত্র বলেছেন, তিনি (টিউলিপ) তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা ‘সব অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছেন’ এবং দাবি করেছেন, ‘এসব বিষয়ের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত নন’।

শরণার্থী সংকট ব্যবস্থাপনা

অধ্যাপক ইউনূসের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভিড়। দীর্ঘদিন ধরেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশটির বিচ্ছিন্নতাবাদীদের লড়াই চলছে। দেশটির দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধে সহিংসতা তীব্র আকার নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানত মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিমদের পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসার সংখ্যা অনেক বেড়েছে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, তাঁরা এখন মিয়ানমারের বিদ্রোহী দলগুলোর সঙ্গে সম্ভাব্য ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গড়ে তোলার বিষয়ে কথা বলছেন, প্রাথমিকভাবে যেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে সহায়তা করা যায়।

বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থীশিবিরের অবস্থান। ওই শরণার্থীশিবিরে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করে। ফলে সেখানে ‘সহিংসতা, মাদক ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দৌরাত্ম্য’ বেড়ে গেছে।
অধ্যাপক ইউনূস কক্সবাজারের বড় বড় সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘এই উদ্বেগ খুব দ্রুতই শেষ হচ্ছে না।’