দক্ষিণ এশিয়ায় চিকিৎসক-নার্সদের বেতন সবচেয়ে কম বাংলাদেশে

ডাক্তারপ্রতীকী ছবি

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চিকিৎসক ও নার্সদের বেতন–ভাতায় সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। চিকিৎসক, নার্সসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন–ভাতা কম থাকার কারণে তাঁদের মধ্যে অসন্তুষ্টি রয়েছে। এতে সেবা ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতে পৃথক বেতনকাঠামো দরকার।

মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘স্বাস্থ্য খাতে কর্মরত সরকারি-বেসরকারি জনবলের বেতন নীতি: বর্তমান বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় আলোচকেরা এসব কথা বলেন। আলোচনা সভার আয়োজন করে স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা নাগরিক সংগঠন ‘অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ’। আলোচনায় স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন, শ্রম সংস্কার কমিশন ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য, সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের চিকিৎসক, সরকারি কর্মকর্তা, পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশে বছরে গড়ে একজন চিকিৎসক বেতন পান তিন লাখ টাকা। আর একজন নার্স পান ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে একজন চিকিৎসক বছরে বেতন পান ১৬ লাখ টাকার বেশি। অন্যদিকে নার্স পান প্রায় সাত লাখ টাকা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নেপালে একজন চিকিৎসক বছরে বেতন পান ১০ লাখ টাকার বেশি আর একজন নার্স পান ৫ লাখ টাকা। একইভাবে তিনি পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা দেখান। স্বাস্থ্য খাতে এমন বৈষম্যের কারণে এ খাতে মেধা পাচার এবং জনবলসংকট দেখা দিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

প্রবন্ধে আরও বলা হয়, দেশে স্বাস্থ্য খাতের কর্মীদের জন্য আলাদা বেতনকাঠামো নেই। সরকারি চাকরিজীবীরা জাতীয় পে স্কেলে বেতন পেলেও বেসরকারি খাতে একেক জায়গায় একেক রকম বেতন দেওয়া হয়। বেসরকারি খাতে কোনো ন্যূনতম মানদণ্ডও নেই।

সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ খান। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতের কর্মীদের জন্য ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করতে হবে। বেতন এমন হতে হবে, যেন তা দিয়ে জীবনযাপনের ব্যয় ভালোভাবে বহন করা যায়। পাশাপাশি বেতনের বাইরেও আবাসন, যাতায়াতের মতো অন্য সুযোগ–সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে হবে।

সরকার গঠিত পে কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ আতিকুল হক বলেন, সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের কর্মীদের বেতন এমন হওয়া উচিত, যাতে তাঁকে অতিরিক্ত আয়ের জন্য বিকল্প খুঁজতে না হয়। এতে প্রতিষ্ঠানের প্রতি কর্মীর দায়িত্ববোধ বাড়বে এবং সেবার মানও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে চার সদস্যের পরিবাবের জন্য ন্যূনতম বেতন ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা এবং ঢাকার বাইরের জন্য ২৫ হাজার টাকা হওয়া উচিত।

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে হলে মজুরি ঠিক করতে হবে। সংবিধানের মূলনীতিতে স্পষ্টভাবে বলা আছে, কাজ হবে মর্যাদার এবং সেই মর্যাদা রক্ষায় যৌক্তিক মজুরি দিতে হবে। এটা না মানার কারণেই দেশে এই তুঘলকি কাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে। এটা সমাজ, প্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাত সবকিছুকে গ্রাস করে ফেলেছে।

স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, চিকিৎসকদের জন্য সঠিক বেতন নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে যাঁরা প্রান্তিক এলাকায়, পার্তব্য এলাকায় দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁদের জন্য ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ ঝুঁকি ভাতা নিশ্চিত করতে হবে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আশরাফী আহমদ বলেন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে যোগ দিয়ে তিনি কর্মীদের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও বৈষম্য দেখছেন। পরিবার পরিকল্পনা সহকারী ও স্বাস্থ্যসেবা সহকারী একই কাজ করে থাকলেও তাঁদের মধ্যে গ্রেড বৈষম্য রয়েছে। তিনি বলেন, পরিবার পরিকল্পনায় ২৪৮ ক্যাটাগরির জনবল রয়েছে, যাঁদের পদন্নোতির জন্য নির্দিষ্ট কেনো নিয়োগবিধি পর্যন্ত নেই।

সভায় স্বাগত বক্তব্যে অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস, বাংলাদেশের সহ-আহ্বায়ক জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, স্বাস্থ্য খাতসহ অন্যান্য খাতের বেতন নীতি পুনর্মূল্যায়ন করার যে সুপারিশ, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত। এটা নিয়ে রাজনৈতিক দ্বিমত হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

আলোচনায় একাধিক আলোচক স্বাস্থ্য খাতে বিরাজমান নানা বৈষম্যের কথা তুলে ধরেন। ক্যাডার বৈষম্যের উল্লেখ করে কেউ কেউ বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা যে সুযোগ–সুবিধা পান, তা স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে নেই। তাই স্বাস্থ্যসেবা খাতে পৃথক বেতনকাঠামোর দাবি জানান তাঁরা। বক্তারা আরও বলেন, স্বাস্থ্য খাতে আয়া ও ওয়ার্ডবয়দের বেতন–ভাতা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা কম হয়। এদের সন্তুষ্টি না থাকলে হাসপাতালে সেবার মান বাড়বে না।

সভায় আরও বক্তব্য দেন নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য খালিদা হানুম আক্তার, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) মহাসচিব জহিরুল ইসলাম শাকিল, ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) মহাসচিব অধ্যাপক মো. মাহমুদ হোসেন, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল অনুষদের ডিন সাখাওয়াত হোসেন, নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভানেত্রী জাহানারা বেগম, মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি মোস্তাক রহিম প্রমুখ। সভাটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ।