বন্যা পরিস্থিতি
১০ লাখ পরিবার পানিবন্দী
পানি কমতে শুরু করেছে। অনেক এলাকা এখনো বিচ্ছিন্ন। আটকা রয়েছেন লাখো মানুষ।
বৃষ্টি কমে আসায় দেশে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। অনেক জায়গায় পানি নামতে শুরু করেছে। তবে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লার অনেক উপজেলায় পরিস্থিতি এখনো খারাপ। এর মধ্যে ফেনীর গ্রামাঞ্চলে অন্তত এক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আটকে আছেন। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ফেনীর বন্যাকবলিত এলাকায় মুঠোফোন নেটওয়ার্ক ভালোভাবে কাজ করছিল না। ফলে সেখানকার প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণাও পাওয়া যায়নি।
বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে শুকনা খাবার ও সুপেয় পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। অনেক জায়গায় স্বেচ্ছাসেবীরা ত্রাণ নিয়ে পৌঁছাতে পারছেন না।
সরকারি হিসাবে, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্যায় দেশে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ৫ জন, কুমিল্লায় ৪ জন, নোয়াখালীতে ৩ জন, কক্সবাজারে ৩ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ জন, ফেনীতে ১ জন ও লক্ষ্মীপুরে ১ জন মারা গেছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০ আগস্ট থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশের ১১টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। সেগুলো হলো ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। এসব জেলার ৭৭টি উপজেলা আক্রান্ত হয়েছে। মোট ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৯০১টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৫০ লাখ ৯৩ হাজার ৫৩০। চিকিৎসাসেবায় চালু রয়েছে ৭৬৯টি মেডিকেল টিম।
মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়িতে বন্যার্তদের উদ্ধার কার্যক্রমে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ও কন্টিনজেন্ট নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।
ফেনীর গ্রামাঞ্চলে পানিবন্দী লাখো মানুষ
এবার যেসব জেলায় বন্যার ভয়াবহতা বেশি, তার একটি ফেনী। ফেনী সদর উপজেলার ১০ নম্বর ছনুয়া ইউনিয়নের উত্তর টংগিরপাড় হাজিবাড়ি এলাকায় এক পরিবারের সাতজন চার দিন ধরে আটকে আছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। কোনো নৌকাও উদ্ধারে যেতে পারছে না। ওই পরিবারের একজন সদস্য পেশায় শিক্ষক ফারজানা আক্তার আছেন চট্টগ্রাম নগরে। তিনি প্রথম আলোকে এই তথ্য জানিয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রাম জেলার উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের চারটি দল ফেনীতে গতকাল উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে ২৭ জনকে উদ্ধার করে। স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা মনে করছেন, অন্তত এক লাখ মানুষ এখনো তাঁদের বাড়িঘরে আটকে আছেন।
# বন্যাকবলিত ১১ জেলা: ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার।
# সাত জেলায় গতকাল পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যু।
# ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা প্রায় ৫১ লাখ।
# মোট ৩ হাজার ৫১৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
# আশ্রয়কেন্দ্রে ৩ লাখের বেশি মানুষ।
# চিকিৎসাসেবায় চালু রয়েছে ৭৬৯টি মেডিকেল টিম।
ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, ফেনী সদর, দাগনভূঞা ও সোনাগাজী—এ ছয় উপজেলা পুরোপুরি বন্যাকবলিত। স্থানীয় স্কুল-কলেজ, মসজিদ ও মন্দিরের ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। সেখানে সুপেয় পানি ও খাবারের সংকট আরও প্রকট হয়েছে।
চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া ত্রাণবাহী ট্রাক ও উদ্ধারের কাজে যুক্ত স্বেচ্ছাসেবীরা প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে পৌঁছাতে পারছেন না। রাস্তার ধারের গ্রামগুলোতে তাঁরা ত্রাণ দিচ্ছেন। স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন, গতকাল সকাল সাতটা থেকে বিকেল পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ৭০ জনকে তাঁরা উদ্ধার করেছেন।
গত বুধবার সন্ধ্যা থেকে ফেনীতে বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তবে গত তিন দিন বৃষ্টি না হওয়ায় ফেনী সদরের কিছু এলাকায় পানি নেমেছে।
বুড়িচংয়ে দুর্ভোগ
অতিবৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে বৃহস্পতিবার রাতে গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। এতে গতকাল বিকেল পর্যন্ত কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ১০৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়। বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহিদা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, গোমতীর বাঁধভাঙার ঘটনায় ৯টি ইউনিয়নের ১ লাখ ৭৫ হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ১০ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন।
আকস্মিক বন্যায় আক্রান্ত এলাকার অনেক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেননি। তাঁদের অনেকে অবস্থান নিয়েছেন বাড়ির ছাদে। সেখানে চলাচলের জন্য নৌকা ও খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গতকাল দুপুরে বুড়িচং উপজেলার ভরাসার, ইছাপুরা ও খাড়াতাইয়া, বাকশিমূল, রাজাপুর এলাকায় এমন দৃশ্য দেখা গেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পীরযাত্রাপুর, সাদেকপুর, আনন্দনগর, ষোলনলে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, কুমিল্লা-বুড়িচং সড়কে অনেকে ত্রাণসহায়তা নিয়ে গেছেন। তবে যাঁরা মাইক্রোবাস নিয়ে গেছেন, তাঁদের ফেরত আসতে হয়েছে। সড়কে বিভিন্ন স্থানে হাঁটুপানি ও তীব্র স্রোত। ট্রাক্টর ও পিকআপ ভ্যান নিয়ে মূল সড়কে গিয়ে ত্রাণ দেওয়া যাচ্ছে। যারা পিকআপ ভ্যানে নৌকা নিয়ে গেছেন, তাঁরা গ্রামের ভেতর থেকে লোকজনকে উদ্ধার করতে পারছেন।
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুল লতিফ জানান, এখনো গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে।
কুমিল্লার নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ ও চৌদ্দগ্রামে বন্যার পানি কিছুটা কমলেও শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণসহায়তার প্রয়োজন বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ত্রাণসামগ্রী বিতরণ চলছে বলে জানান কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মু মুশফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘দুর্গত এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষের জন্য শুকনা খাবার, স্যালাইন ও ওষুধ মজুত আছে। ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত আছে।’
নোয়াখালীর কোথাও অবনতি, কোথাও উন্নতি
গত ২৪ ঘণ্টায় নোয়াখালীতে তেমন বৃষ্টি হয়নি। নোয়াখালী সদর, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সুবর্ণচর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
তবে সেনবাগ, সোনাইমুড়ী ও বেগমগঞ্জ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। আর চাটখিল উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি কার্যত অপরিবর্তিত রয়েছে।
সেনবাগ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিসান বিন মাজেদ প্রথম আলোকে বলেন, সেনবাগের বন্যা পরিস্থিতি আগের দিনের তুলনায় অবনতি হয়েছে। পাশের জেলা ফেনী থেকে বন্যার পানি আসার কারণে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। তিনি জানান, উপজেলার ১২৫টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে এরই মধ্যে প্রায় ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
গতকাল সকালে সরেজমিনে বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌরসভা, গণিপুর, করিমপুর, একলাছপুর ও লক্ষ্মীনারায়ণপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি বাড়িতে হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানি। বসতঘরগুলো বেশির ভাগই ডুবে আছে হাঁটুপানিতে। পানিবন্দী মানুষজন চরম মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
বিভিন্ন জায়গায় পানি কমছে
পানি কিছুটা কমলেও লক্ষ্মীপুর জেলার পাঁচটি উপজেলা এখনো প্লাবিত। লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান জানান, শুক্রবারের তুলনা গতকাল পানি কিছুটা কমেছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান প্রথম আলোকে বলেন, পানিবন্দী হয়ে সাড়ে ছয় লাখ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। রামগঞ্জ, কমলনগর ও রামগতি উপজেলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গত এলাকার লোকজনকে শুকনো খাবারসহ ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় মূল সড়কসহ ১০টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার অন্তত ২০টি সড়ক অচল হয়ে গেছে। উপজেলার কয়েকটি জায়গায় পানি নেমে গেলেও শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত গুমাই বিলের রোপা আমন ধানখেত পানির নিচে। আরও কয়েক দিন পানি থাকলে আমন চারা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।
কক্সবাজারের ছয়টি উপজেলা থেকে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। তাতে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও মানুষের দুর্ভোগ যাচ্ছে না। পানিতে ডুবে থাকা অন্তত ৪৫ হাজার ঘরবাড়িতে খাদ্য ও সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, বন্যাদুর্গতদের জন্য বরাদ্দকৃত ৮৫ মেট্রিক টন চাল ঘরে ঘরে পৌঁছানো হচ্ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত উপজেলার হাওড়া নদীর গঙ্গাসাগর পয়েন্টে পানির সীমা ছিল ৫ দশমিক ৫৮ মিটার। গতকাল তা বিপৎসীমার ৫১ সেন্টিমিটার নিচে নেমে আসে।
যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় গত বুধবার সকাল থেকে আখাউড়া ইমিগ্রেশন দিয়ে ভারতে যাত্রী পারাপার বন্ধ আছে।
তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় নতুন করে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উপজেলার তিন ইউনিয়নের ২৬টি গ্রামের ২ হাজার ৩৫০ পরিবারের ১৫ হাজার ৫০০ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছেন। কসবা-নয়নপুর সড়কের বায়েক মোড় ভেঙে যাওয়ায় আঞ্চলিক সড়কে কুমিল্লার সঙ্গে কসবাসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যোগাযোগ বন্ধ আছে। পাশাপাশি তিন ইউনিয়নের অধিকাংশ সড়ক পানিতে তলিয়ে যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
আশ্রয়কেন্দ্রে ৩ লাখ মানুষ
গতকাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য মোট ৩ হাজার ৫১৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ৩ লাখ ১ হাজার ৯৯৩ জনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোতে জেলা প্রশাসককে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, মেডিকেল টিম ও অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা।]