গ্রীষ্মের ছুটিতে মা, বড় খালা, ছোট খালা—সবাই একসঙ্গে নানুবাড়ি গিয়ে একত্র হতেন। যে পথ দিয়ে নানুবাড়ি যেতে হতো, সেখানে ছিল একটা বড় আমগাছ। তার নিচে ছিল ছোট্ট একটা পানদোকান। চুন, সুপারি, ধনে, মৌরি আর মিষ্টি জর্দা দিয়ে দোকানি পান বিক্রি করতেন। মিষ্টি জর্দার লোভে কতবার যে নানুকে পান এনে দিয়ে তাতে ভাগ বসাতাম!
বড় খালা আসতেন রংপুর থেকে। বানিয়ে আনতেন জর্দা পোলাও আর পুডিং। চিকন করে কাটা কাঠবাদাম আর ছোট ছোট কালো মিষ্টি দিয়ে জর্দা পোলাও দেখতে যে কী অপূর্ব হতো! অত দূর থেকে পুডিংটা সুরক্ষিত অবস্থায় যে তিনি নিয়ে আসতেন, সে ছিল এক মস্ত জাদুকরি ব্যাপার।
নানুর বাড়িটা ইংরেজি এল আকৃতির। বারান্দার সামনে বড় কামিনীগাছে থোকায় থোকায় ফুল ফুটে থাকত। আর নানার ঘরের পেছনে ছিল বিরাট এক কাঁঠালগাছ। এত বড় কাঁঠালগাছ আমি দ্বিতীয়টা আর জীবনে দেখিনি।
ও কী অদ্ভুত কথা! বিরাট মোটা সেই গাছের গায়ে কোথাও কোথাও অবশ্য বড় বড় গর্ত ছিল। কিন্তু গাছে কী আবার সাপ থাকে নাকি?
কাঁঠালগাছের ছড়ানো ছায়া আর খোলা হাওয়ার কারণে নানার ঘরের পেছনে বসে আমরা খেলতাম। মাটি দিয়ে কেক বানাতাম। কেকের ওপরটা ইটের গুঁড়া দিয়ে লাল করা হতো। কাঁঠালের মুছি দিয়ে হতো আরও নানা পদের জিনিস। কাঁঠালপাতা হতো প্লেট। মা, খালামণি আর নানুরা মাঝেমধ্যে এসে আমাদের দেখে যেতেন। কাঁঠালগাছটা দেখিয়ে বলতেন, ওদিকে যেয়ো না। সাপ আছে।
ও কী অদ্ভুত কথা! বিরাট মোটা সেই গাছের গায়ে কোথাও কোথাও অবশ্য বড় বড় গর্ত ছিল। কিন্তু গাছে কী আবার সাপ থাকে নাকি?
গাছটাতে প্রচুর কাঁঠাল ধরত। কেউ সাহস করে পাড়ত না। কাঁঠালের ক্রেতারা এলে তবেই নানু বিক্রি করতেন। তাঁরা কিছু কাঁঠাল আমাদের দিয়ে যেতেন। অনেক সময় পাকা কাঁঠাল মাটিতে পড়ে ফেটে যেত।
বিকেল হতে না হতে সবাই ঘর থেকে বের হতো বারান্দায়। সিঁড়িতে বা বারান্দায় বসেই বিকেলের চা–নাশতা চলত। কোনো কোনো রাতে বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে আমরা জ্যোৎস্নায় শুয়ে পড়তাম। বাঁকা চাঁদের তলায় মেঘেদের যাওয়া–আসা দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে যেতাম।
মামা এবার খুব রেগে গেলেন। নানুকে বললেন, কাঁঠালগাছটা কেটেই ফেলতে হবে। নানু কিছুতেই রাজি হলেন না।
খুব ভোরে সূর্যের আলোয় ঘুম চটে যেত। উঠানে কামিনী ফুল ঝরে মাটি হয়ে থাকত শুভ্র বিছানা। বাতাস মাতাল করে রাখত ফুলের সুবাস।
একদিন রাতের খাওয়া শেষ করেছি। খালা উঠানে গ্লাসের পানি ফেলার সময় দেখেন সাদা ফুলের পাপড়ির মধ্যে কী যেন চিকচিক করছে। ও মা, এ তো ইয়া লম্বা একটা সাপ। সাপ, সাপ! আমরা ছোটরা ভয়ে পা তুলে একদম বিছানায়। মামার কর্মচারীরা এসে পিটিয়ে সাপ মারল। রাত কাটল ভয়ে ভয়ে। দরজার নিচে চটের বস্তা গুঁজে দেওয়া হলো, যেন সাপ ঢুকে যেতে না পারে।
পরদিন ঘুম ভাঙার পর শুরু হলো গবেষণা। সাপ এল কোত্থেকে। কেউ বলল, ফুলের সুবাসে সাপ এসেছে। কেউ বলল, কাঁঠালগাছ থেকে।
দুপুরে ডাইনিং টেবিলে বসেছি। ছোট খালা ভাত তোলার জন্য পাতিলে হাত দিয়েছেন, অমনি পাতিলের পেছন থেকে ফণা তুলল সাপ। ছোট খালার চিৎকারে রাস্তা থেকে দু–একজন এসে কুপোকাত করল সাপটাকে। সবাই বলাবলি করল, এটা গত রাতে মারা সাপের জোড়া। সঙ্গীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এসেছে।
মামা এবার খুব রেগে গেলেন। নানুকে বললেন, কাঁঠালগাছটা কেটেই ফেলতে হবে। নানু কিছুতেই রাজি হলেন না। বললেন, তিনি নাকি স্বপ্নে দেখেছেন, এ গাছ কাটলে অমঙ্গল হবে। মামা কোনো কথা কানে নিলেন না। গাছিয়া খুঁজতে শুরু করলেন। নির্ধারিত দিনে গাছিয়ারা এলেন। তাঁরা সকালে গাছ কাটতে শুরু করলেন। কাটতে কাটতে বিকেল। গাছ কেটে নিয়ে তাঁরা চলে গেলেন। কিন্তু একটি সাপও বের হলো না। কিছুদিন পর কামিনীগাছটাও কেটে ফেলা হলো।
গাছ দুটির সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাড়ির আনন্দটাই কেমন চলে গেল। নানু সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দাওয়ায় এসে ন্যাড়া উঠানের দিকে তাকিয়ে আপনমনে কী যেন ভাবেন। আমরা আগের মতোই নিয়মিত নানুকে দেখতে যেতাম। কিন্তু নানুবাড়িতে আগের আনন্দ আর পেতাম না।
একদিন নানু ছোট মামাকে কিছু টাকা দিয়ে কামিনীগাছের জায়গাটা দেখিয়ে বলল, ওখানে একটা লিচুগাছ লাগিয়ে দাও। লাগানো হলো। দিনে দিনে বড় হলো গাছটা। পাতার ফাঁকে ফাঁকে আবার বসতে লাগল পাখি। বাড়িটাতে প্রাণ ফিরে এল। আনন্দে ভরে উঠল বাড়ি। নানু বারান্দায় বসে আমাদের দেখতেন, আর মুচকি মুচকি হাসতেন।
কিন্তু সেই কাঁঠালতলার শূন্যতা আমার মন থেকে আজও গেল না।
নার্গিস আখতার, সহকারী শিক্ষক, ফেলানপুর রেনেসাঁ উচ্চবিদ্যালয়, ঠাকুরগাঁও