জমি বেচে, চাকরি ছেড়ে অসহায় বৃদ্ধদের পাশে রফিকুল

বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় পাওয়া নারীদের সঙ্গে রফিকুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী (বাম দিক থেকে তৃতীয়)
ছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এলে মন খারাপ হতো রফিকুল ইসলামের। সেখানকার সড়কে নাম-পরিচয়হীন অসহায় বৃদ্ধদের পড়ে থাকতে দেখে তাঁর ভেতরটা কেমন করে উঠত।

সড়কে পড়ে থাকা বৃদ্ধ এই মানুষগুলোর মধ্যে কেউ চোখে দেখতেন না। কেউ কানে শুনতেন না। কেউ আবার হাঁটতে পারতেন না।

হতভাগা মানুষকে দেখে রফিকুলের মা–বাবার কথা মনে পড়ত। তিনি ভাবতেন, এই মানুষগুলো যদি তাঁর মা–বাবা হতেন, তাহলে কি তিনি তাঁদের এভাবে সড়কে পড়ে থাকতে দিতেন!

দিন দিন রফিকুলের মনঃকষ্ট বাড়ে। এসব মানুষের জন্য কিছু একটা করার তাগিদ খুব করে অনুভব করেন তিনি।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করছিলেন রফিকুল। একদিন তিনি সাহস করে তাঁর স্ত্রী কল্পনা আক্তারকে বলেন, ‘আমরা তো কোনো দিন শিল্পপতি হতে পারব না। আমাদের যা আছে, তা–ই দিয়ে অসহায় বৃদ্ধ মানুষের সেবাযত্ন করলে কেমন হয়!’

কল্পনা তাঁর স্বামীকে ভালো করেই চেনেন। স্বামীর মন বোঝেন। তিনি উত্তর দিলেন, ‘দেহো, আমাদের কাছে অত অর্থসম্পদ নাই। যদি কম লোক হয়, তাহলে ইনশা আল্লাহ তাঁদের খাওয়াতে পারব।’

এভাবেই শুরু। রফিকুল ২০০৯ সালে ৮ শতাংশ জমির ওপর গড়ে তোলেন ‘মাতৃছায়া সমাজকল্যাণ সংস্থা ও বৃদ্ধ আশ্রয় কেন্দ্র’। সেখানে এখন আটজন নারী ও একজন পুরুষ আছেন।

রফিকুলের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার বীর বেতাগৈর ইউনিয়নের উত্তর বাজারের পূর্ব পাশে। তাঁর গড়া বৃদ্ধাশ্রমটি পড়েছে উপজেলার চরবেতাগৈর ইউনিয়নের উত্তর কামটখালী গ্রামে। রফিকুলের বাড়ি থেকে বৃদ্ধাশ্রমের দূরত্ব আধা কিলোমিটারের কম।

জমি বিক্রি

বৃদ্ধাশ্রমের জন্য জায়গা কিনতে রফিকুলকে তাঁর ময়মনসিংহ শহরের শম্ভুগঞ্জ এলাকায় থাকা ২ শতাংশ জমি বিক্রি করতে হয়। বৃদ্ধাশ্রমের ঘর নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক প্রয়োজনে রফিকুল আরও ২০ শতাংশ জমি বিক্রি করেন।

রফিকুল বলেন, তিনি জানতেন যে বৃদ্ধাশ্রম গড়তে, চালাতে টাকা লাগবে। কিন্তু তাঁর তেমন টাকা-পয়সা নেই। তা সত্ত্বেও সাহস করে কাজটা তিনি শুরু করেন। সে জন্য তাঁকে জমি বিক্রি করতে হয়।

রফিকুলের স্ত্রী কল্পনা বলেন, গ্রামবাসীসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ তাঁদের বৃদ্ধাশ্রমে খাবার দেন। অর্থ হায়তা দেন। তা দিয়ে বৃদ্ধাশ্রম চলে। তবে মাঝেমধ্যে তাঁরা সংকটে পড়ে যান।

ছেড়েছেন চাকরি

বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে গীতা রানী, এলাচি বেগম, ফুলবানু, হোসনা বেগম ও রোকেয়া বেগম হাঁটতে পারেন না। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ হাসপাতালের সামনে পড়ে ছিলেন। কেউ পড়ে ছিলেন বাজারে। তাঁদের সব সময় দেখাশোনা ও সেবাযত্নের প্রয়োজন হয়। এ কাজে পূর্ণ সময় দিতে রফিকুল বছরখানেক আগে হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষীর চাকরিটি ছেড়ে দেন। এখন তিনি সার্বক্ষণিক এসব মানুষের সেবা-শুশ্রূষা করছেন।

রফিকুল বলেন, ‘আমি তাঁদের কাছে গেলে তাঁরা আমায় বাবা বাবা বলে ডাকে। আমিও তাঁদের বাবা বা মা বলে ডাকি। তাঁরাই আমার মা-বাবা।’

বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় পাওয়া নারী-পুরুষদের দেখাশোনার কাজ রফিকুলের স্ত্রীও করেন। তাঁদের সঙ্গে আছেন ফাহিমা আক্তার ও সোহেল মিয়া নামের দুজন।

রফিকুলের সাবেক সহকর্মী সোহেল। রফিকুলের উদ্যোগটি ভালো লাগায় তিনি এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। আর ফাহিমা স্থানীয় অধিবাসী।

বৃদ্ধাশ্রমে একজন বেতনভুক্ত রাঁধুনি আছেন। তাঁকে মাসে ২ হাজার ৫০০ টাকা দেওয়া হয়।

মহৎ উদ্যোগ

চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি মাতৃছায়া সমাজকল্যাণ সংস্থা ও বৃদ্ধ আশ্রয় কেন্দ্রে একটি ঘর তুলে দিয়েছে সেবা সংগঠন ‘এপেক্স ক্লাব অব ময়মনসিংহ’।

দুই রুমবিশিষ্ট ৪২ ফুটের এই ঘরে অন্তত ১৫ জন থাকতে পারেন। এ ছাড়া খাবারের জিনিসপত্র রাখা ও নামাজের জন্য আলাদা ঘর করা হয়েছে।

ময়মনসিংহ জেলা এপেক্স ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও টাঙ্গাইল শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক আশিকুর রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, রফিকুল প্রথম যখন উদ্যোগটির কথা বলেছেন, তখন তাঁর বিশ্বাস হয়নি। নিজ চোখে দেখার পর তাঁকে সহযোগিতার চেষ্টা করছেন তিনি।

আশিকুর বলেন, ‘রফিকুল একটা ভালো কাজ করছেন। সমাজে তাঁর মতো মানুষ আরও দরকার।’

বীর বেতাগৈর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য আব্দুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, রফিকুলের উদ্যোগটি মহৎ। তাঁরাও রফিকুলকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করছেন।