সফটওয়্যার কোম্পানির টাকায় বিদেশে সম্মেলনে
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যাওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিদেশি সফটওয়্যার কোম্পানির কাছে অর্থ চেয়েছে। ওই কোম্পানির সঙ্গে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লেনদেন আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা ক্রয় আইনের লঙ্ঘন। চারজন বিদেশগামী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁরা নিজের অর্থে সম্মেলনে যাচ্ছেন।
যক্ষ্মা ও ফুসফুসের রোগের আন্তর্জাতিক বার্ষিক সম্মেলন ইউনিয়ন কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হবে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে। সম্মেলন শুরু হচ্ছে ১৮ নভেম্বর, শেষ হবে ২১ নভেম্বর। সারা বিশ্বের যক্ষ্মা ও ফুসফুসের রোগবিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা এই সম্মেলনে যোগ দেবেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস/এসটিডি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সদ্য সাবেক উপপরিচালক জোবায়দা নাসরিন ভারতের সফটওয়্যার কোম্পানি কিউর এআই-কে ৫ অক্টোবর চিঠি দিয়ে অর্থসহায়তার অনুরোধ করেন। বর্তমানে তিনি যক্ষ্মা ও কুষ্ঠরোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার উপপরিচালক।
এটি স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়। যে কোম্পানির সঙ্গে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ব্যবসা আছে, তার কাছে অর্থসহায়তা চাওয়া অনৈতিক। এটা সরকারি ক্রয়বিধির পরিপন্থী। আইনের লঙ্ঘন। এটা ভবিষ্যৎ ক্রয়প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে। এটা গ্রহণযোগ্য না, শাস্তিযোগ্য অপরাধ।ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
চিঠিতে বলা হয়, কোম্পানিটি যেন যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পাঁচ কর্মকর্তাকে ওই সম্মেলনে যোগদান নিশ্চিত করতে অর্থসহায়তা দেয়। কোম্পানিটির কাছে অর্থসহায়তা বাবদ ২২ হাজার ২৭০ ডলারের (প্রায় ২৭ লাখ টাকা) একটি বাজেটও দেওয়া হয়।
সফটওয়্যার কোম্পানির কাছে পাঁচজনের একটি নামের তালিকা পাঠানো হয়। তাঁরা হচ্ছেন যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উপপরিচালক মো. শাফিন জব্বার, জাতীয় কর্মসূচি সমন্বয়ক রূপালি শিশির বাণু, যক্ষ্মা ল্যাবরেটরি বিশেষজ্ঞ উম্মে তাসনিম মালিহা, বিভাগীয় যক্ষ্মাবিশেষজ্ঞ (ঢাকা উত্তর) ফারজানা জামান এবং সহকারী পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ এফ এম মনিরুল হক। প্রথমজন সরকারি কর্মকর্তা। বাকি চারজন দাতা সংস্থা গ্লোবাল ফান্ডের কর্মকর্তা। এই চারজন জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অফিসে বসে কাজ করলেও তাঁদের বেতন–ভাতা দেয় গ্লোবাল ফান্ড।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এর আগে ২০২১–২২ ও ২০২২–২৩ অর্থবছরে কিউর এআইয়ের কাছ থেকে সফটওয়্যার কিনেছে। এই সফটওয়্যার কেনা হয় গ্লোবাল ফান্ডের টাকায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই সফটওয়্যার যক্ষ্মা শনাক্তের কাজে ব্যবহৃত হয়।
সংশ্লিষ্ট একজন সরকারি, তিনজন বেসরকারি ও একজন দাতা সংস্থার প্রতিনিধি প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, আরও সফটওয়্যার কেনার প্রক্রিয়া চলমান। কোন কোম্পানির কাছ থেকে তা কেনা হবে, তা চূড়ান্ত হয়নি। এরই মধ্যে একটি কোম্পানির কাছে অর্থসহায়তা চেয়ে জোবায়দা নাসরিনের এই চিঠি নানা সন্দেহ তৈরি করেছে।
তাঁরা কিছুই জানতেন না
চিঠিতে উল্লেখিত পাঁচজনের সঙ্গে ১৩ নভেম্বর মুঠোফোনে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেছেন, জোবায়দা নাসরিন তাঁদের না জানিয়ে, তাঁদের সম্মতি না নিয়ে তালিকায় তাঁদের নাম দিয়েছেন।
তাঁদের মধ্যে মো. শাফিন জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশ যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। তালিকায় নাম আছে, তা আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম। আমাকে না জানিয়ে, আমার সম্মতি ছাড়া আমার নাম প্রস্তাব করা খুবই গর্হিত কাজ হয়েছে।’ জোবায়দা নাসরিন চিঠি পাঠান ৫ অক্টোবর, আর মো. শাফিন জব্বার উপপরিচালক পদে যোগ দেন ৯ অক্টোবর।
১৩ নভেম্বর জোবায়দা নাসরিনকে ফোন করেন এই প্রতিবেদক। তিনি মুঠোফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি এই প্রতিবেদককে তাঁর কার্যালয়ে যাওয়ার কথা বলেন। এই প্রতিবেদক পৌঁছানোর আগেই তিনি যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কার্যালয় থেকে ফারজানা জামান এবং এফ এম মনিরুল হককে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তাঁর কক্ষে ডেকে পাঠান।
বিদেশ যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। তালিকায় নাম আছে, তা আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম। আমাকে না জানিয়ে, আমার সম্মতি ছাড়া আমার নাম প্রস্তাব করা খুবই গর্হিত কাজ হয়েছে।যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উপপরিচালক মো. শাফিন জব্বার
জোবায়দা নাসরিন প্রথম আলোকে বলেন, শুধু মো. শাফিন জব্বারের নামটি তালিকাভুক্ত করার আগে তাঁকে জানানো হয়নি, এটা ভুল। বাকি সবাই আগে থাকতে সবকিছুই জানতেন। তাঁদের পরামর্শে এই তালিকা করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন যে সফটওয়্যার কোম্পানি কিউর এআই–কে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, তার খসড়া করেছেন সহকারী পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ এফ এম মনিরুল হক। যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই চিঠির ব্যাপারে জানেন।
পাশের দুটি চেয়ারে বসে থাকা এফ এম মনিরুল হক ও ফারজানা জামান এর কোনো প্রতিবাদ করেননি।
আপনি কেন কিউর এআইয়ের কাছে অর্থসহায়তা চাইলেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে জোবায়দা নাসরিন বলেন, কয়েক মাস আগে কিউর এআইয়ের প্রতিনিধিরা ঢাকায় এসেছিলেন। অন্যান্য কর্মকর্তার উপস্থিতিতে তাঁরা বলেন, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কেউ ইউনিয়ন কনফারেন্সে যোগ দিতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সহায়তা দিতে পারে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে চিঠি পাঠান তিনি।
ওই চিঠিতে জোবায়দা নাসরিন লেখেন, কিউর এআইয়ের আর্থিক সহায়তা পেয়ে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কর্মকর্তারা সম্মেলনে যোগ দিতে পারলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। প্রতিনিধিরা যক্ষ্মা বিষয়ে বাংলাদেশের অর্জন সম্মেলনে তুলে ধরতে পারবেন, বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তাঁদের অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে, যক্ষ্মা নির্মূলে বৈশ্বিক সহযোগিতা প্রচেষ্টা দৃঢ় হবে।
আপনি কেন কিউর এআইয়ের কাছে অর্থসহায়তা চাইলেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে জোবায়দা নাসরিন বলেন, কয়েক মাস আগে কিউর এআইয়ের প্রতিনিধিরা ঢাকায় এসেছিলেন।
দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়। যে কোম্পানির সঙ্গে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ব্যবসা আছে, তার কাছে অর্থসহায়তা চাওয়া অনৈতিক। এটা সরকারি ক্রয়বিধির পরিপন্থী। আইনের লঙ্ঘন। এটা ভবিষ্যৎ ক্রয়প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে। এটা গ্রহণযোগ্য না, শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’