বুননশিল্পকে আগলে থাকা একজন হরেন্দ্র

শীতলপাটি দেখাচ্ছেন হরেন্দ্র কুমার দাশছবি: সংগৃহীত

প্রায় ৩৩ বছর আগে মেয়ের বিয়েতে শীতলপাটি উপহার দিয়েছিলেন মৌলভীবাজারের রাখাল চন্দ্র দাশ। তিনি বেঁচে নেই। তবে শতছিন্ন সে পাটির খানিকটা অংশ এখনো আছে মেয়ে দীপ্তি রানীর কাছে। বিয়ের সময় পাটি উপহার পাওয়ার গল্প বলছিলেন দীপ্তি রানীর স্বামী হরেন্দ্র কুমার দাশ। বুননশিল্পের দক্ষতায় নিজের বাবা, ঠাকুরদা, শ্বশুরের কৌলীন্যকে হরেন্দ্র কুমার দাশ বহু আগেই অতিক্রম করেছেন।মৌলভীবাজারের রাজনগরের ধুলিজুড়া গ্রামের এই হরেন্দ্র কুমার শীতলপাটির জমিনে দাবার ছক বা চামার কাঁটার মতো জটিল নকশা তুলতে পারেন অনায়াসে। শীতলপাটিকে ইউনেসকোর তরফ থেকে ‘নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় তাঁদের পাটি বুনে দেখিয়েছিলেন হরেন্দ্র।

হরেন্দ্র প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বানানো পাটি মেলে ধরা হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার সেই সম্মেলনে। এর পরপরই বিশ্বস্বীকৃতির ঘোষণা আসে। তখন আমার অনুভূতি বলে বোঝানোর ভাষা জানা নেই। ৪ ফুট বাই ১০ ফুটের সে পাটিতে ছিল পাখি, পালকি, ঘোড়া, বাঘ, শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধের নকশা। আমার পূর্বপুরুষের পেশাও একই ছিল। কেমন করে এত সহজে ছাড়ি?’

পুকুরের পানিতে মোর্তা ভেজানোর কাজ করছেন হরেন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী
ছবি: সংগৃহীত

দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনা পাটি বুননকারীর কাছে তাঁর পেশা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো স্বীকৃতি পাওয়ার পর সাংবাদিকেরা অনেক ছবি তুলতে আসেন। খবর নেন, এরপর ভুলে যান। আমাদের দিনমজুর হয়ে যাওয়ার কান্না আপনারা কোনো দিন শুনতে পারেন না।’

রাজনগরের ধুলিজুড়ায় এককালে ছিল পাটি বুননকারী শতাধিক পরিবার। তখন বালাগঞ্জে মদনমোহন আখড়ার পাশে বুড়ো বটগাছের তলায় বসত শীতলপাটির জমজমাট বাজার। সে বাজার এখন আর বসে না। পাটি বুননকারী পরিবারের সংখ্যাও নেমে এসেছে চার থেকে পাঁচটিতে। প্লাস্টিক পাটির সহজলভ্যতা ও বৈদ্যুতিক পাখার কাছে বহু আগেই প্রয়োজন ফুরিয়েছে শীতলপাটির। এখন শৌখিন কেউ কেউ কিছু টেবিল ম্যাট ও দেয়ালে ঝোলানোর স্মারক হিসেবে শীতলপাটি ব্যবহার করেন। একসময় সিলেটে তৈরি শীতলপাটি মোগল রাজদরবারে শোভা পেয়েছে। এখন সেসব গ্রামের কারিগরদের হাতের আঙুলের ভেতর মোর্তা, বেতের সেই বুনন আর হয় না। দিনমজুর হিসেবে তাঁরা এখন ঝোপঝাড় পরিষ্কার করেন। বংশপরম্পরায় চলে আসা এ পেশায় তাঁরা ছিলেন শিল্পীও। শিল্পী থেকে দিনমজুর হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক। তাঁদেরই একজন রাজনগরের ধুলিজুড়ার বাসিন্দা প্রমেশ চন্দ্র দাস। শৈশব থেকে পাটি বুনতেন তিনি। প্রায় এক যুগ হলো বাধ্য হয়ে বদলেছেন পেশা। প্রথম আলোকে জানালেন, ছয় সদস্যের পরিবারের ন্যূনতম খরচও উঠে আসে না পাটি বানিয়ে বিক্রি করে। এখন বাধ্য হয়ে অন্যের জমিতে কাজ করেন অথবা অন্যের বাড়ির গাছপালার আগাছা পরিষ্কার করেন।

একই এলাকার দ্বিজেন্দ্র দাসের বয়স এখনো ৫০ অতিক্রম করেনি। সাত সদস্যের পরিবার নিয়ে তাঁর অবস্থাও একই। দুজনই জানালেন, শীতলপাটি বোনার জন্য তাঁদের হাত নিশপিশ করে। কিন্তু দিনমজুরের কাজ শেষে এখন আর শখ করেও পাটি বুননের সময়, শক্তি কোনোটিই থাকে না।

তবে বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের পেশা থেকে সরেননি হরেন্দ্র। পাটি বুনেই জীবনের সব অর্জন, কৃতিত্বের গল্প জমা করেছেন তিনি। ঢাকায় শাহবাগে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে হরেন্দ্রর তৈরি কয়েকটি শীতলপাটি।

অভাবের কথা বলতে বলতে কণ্ঠস্বর বদলে যায় ইউনেসকোর ঘোষণার স্মৃতি উসকে আসায়। প্রথম আলোকে জানালেন, দক্ষিণ কোরিয়ার সম্মেলনে তাৎক্ষণিকভাবে নকশা করে দেখাতে বললে তিনি সাদা আর লাল রং দিয়ে তৈরি করেছিলেন তারার মতো একটি ফুল। হরেন্দ্র কুমার দাশের আরেকটি কৃতিত্ব মোর্তা থেকে বেতি তোলায়। সাধারণত ১০ থেকে ১২টি বেতি বের করা গেলেও তিনি ১৮ থেকে ২০টি বেতি বের করতে পারেন। মোর্তা বা ছোট বাঁশজাতীয় কাঁচামালটি এনে ভিজিয়ে রাখা, তা থেকে বেতি বানানো আবার ভিজিয়ে শুকানোর ঝামেলা অনেক। এরপর আছে নকশার জন্য জ্বাল দিয়ে রং করার আয়োজন। এসব কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেন স্ত্রী দীপ্তি রানী। কিন্তু পাটি তৈরির কাঁচামাল সংরক্ষণ যেমন ঝামেলার, তেমনি আছে বাজারে দাম না পাওয়ার হতাশা। এদিকে প্রতিদিন সংসারের নানা চাহিদার কাছে পরাজিত হতে বসেছে পেশার ঐতিহ্য।

ফুল, পশু–পাখির নকশা প্রাধান্য পায় শীতলপাটির জমিনে
ছবি: সংগৃহীত

ইউনেসকোর সম্মেলনের জন্য হরেন্দ্র কুমার দাশ আর গীতেশ চন্দ্র দাশ নামে দুজনকে নির্বাচিত করা প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয়েছিল সামাজিক সংগঠন আইডিয়ার কাছে। আইডিয়ার নির্বাহী পরিচালক নজমুল হক প্রথম আলোকে জানান, জাতীয় জাদুঘরের পক্ষ থেকে শীতলপাটি বুননকারীদের সম্পর্কে তাঁদের কাছে তথ্য চাওয়া হয়। কাজের দক্ষতা বিবেচনায় তখন দুজনের নাম প্রস্তাব করা হয়। ওই দুজন বিভিন্ন সময় পাটি তৈরির প্রশিক্ষকের দায়িত্বও পালন করেছেন। সব কাগজপত্র ও কাজের নমুনা পাঠানোর পর জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালে তাঁদের মনোনয়ন দেয়।

ঢাকা থেকে কিছু বায়না আসে কখনো। সেটিই একমাত্র উপার্জনের ব্যবস্থা হরেন্দ্রর। প্রথম আলোকে জানালেন, শীতলপাটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ৭ ফুট বাই ৫ ফুট মাপের পাটি। হালকা নকশার এসব পাটির দাম ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। নকশা বেশি হলে দাম বাড়তে থাকে। এর কম হলে আমাদের খরচে পোষায় না। আবার এ দামে এখন আর কেউ কিনতেও চায় না।

দুই সন্তান কাজল কান্তি দাশ আর চৈতী রানী দাশের পড়ার খরচ চালানোর মতো টাকাও থাকে না হরেন্দ্রর হাতে। শত প্রতিকূলতার ভেতরেও তিনি ভাবতে পারেন না, যে হাতে তিনি শীতলপাটি তৈরি করেন, সেই হাতে কোদাল ও শাবল ধরে দিনমজুরের কাজ করবেন। কিন্তু চারপাশের পাটি বুননকারী মানুষদের দিনমজুর হয়ে যাওয়ার বেদনা ঠিকই সমানভাবে বাজে তাঁর বুকে। একই সঙ্গে আতঙ্কিত হন নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

এ লড়াইয়ে টিকে থাকার মেয়াদ আর কত দিন, জানেন না নিপুণ এই শিল্পী। কিন্তু বাড়ির উঠানে দাঁড়ালেই তাঁর চোখ চলে যায় পুকুরের ওপারের জংলায়। হরেন্দ্রর বাড়ির ৮০ বছরের পুরোনো পুকুরটি তাঁর ঠাকুরদার আমলে তৈরি। ওই পুকুরেই মোর্তা, বেতি ভিজান তিনি। পুকুর পেরিয়ে এগোলেই জংলার ভেতর তাঁর বাবা ধীরেন্দ্র কুমার দাস আর ঠাকুরদা ঝাড়ুরাম দাসের চিতার চিহ্ন। অন্যরা পেশা বদলালেও তিনি যেন পূর্বপুরুষের স্মৃতি তর্পণ করতেই রয়ে গেছেন শীতলপাটি বোনার পেশায়।