চট্টগ্রাম নগর
গাফিলতির ‘মাশুল’ ২২৪ কোটি টাকা
সিডিএ ও সিটি করপোরেশনের তদারকির দুর্বলতায় খালের পাড়ে নিয়ম না মেনে গড়ে ওঠা স্থাপনার জন্য দিতে হচ্ছে ক্ষতিপূরণ।
খালের পাড় থেকে ১২ ফুটের মধ্যে কোনো ধরনের স্থাপনা করা যাবে না, ২০০৮ সালে প্রণয়ন করা চট্টগ্রাম নগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) দেওয়া হয়েছিল এই নির্দেশনা। বাস্তবে এই নির্দেশনা কাগজেই। খাল ঘেঁষে নির্মিত হয়েছে আবাসিক ভবনসহ নানা স্থাপনা। এসব স্থাপনার নির্মাণ বন্ধে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করেনি।
এখন জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের নির্মাণকাজ এবং সড়ক করার জন্য খালের পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা ১ হাজার ৮০৪টি স্থাপনা অপসারণ করতে হচ্ছে। তবে এ জন্য ভবনমালিকদের সরকারি তহবিল থেকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সিডিএকে, যার পরিমাণ ২২৪ কোটি টাকা।
নগরে অবৈধ, অনুমোদনহীন ও নকশাবহির্ভূত স্থাপনা নির্মাণ প্রতিরোধের মূল দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)। আর খাল ও খালের দুই পাশ দেখাশোনা করে আসছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। দুই সংস্থার গাফিলতিতে বিপুল পরিমাণ টাকা খেসারত দিতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন নগর–পরিকল্পনাবিদেরা। এখন দুটি সংস্থা নিজেদের দায় চাপিয়েছে জনবলসংকটের ওপর।
সিডিএ অবৈধ ও নকশা-বহির্ভূত ভবন নির্মাণকাজ বন্ধ করতে যেভাবে তদারকি করার কথা, তা করেনি। মনোযোগ দেয়নি সিটি করপোরেশনও। তাদের গাফিলতির কারণে ভবনমালিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে, যা জনগণের পকেট থেকেই যাবে।দেলোয়ার মজুমদার, সাবেক চেয়ারম্যান, আইইবি
সিডিএর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কার্যক্রম চলার সময় খালের পাড় ঘেঁষে ভবন থাকার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। নির্মাণকাজের সময় এক বছরে দুটি খালে অন্তত তিনটি ভবন হেলে পড়েছে। ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর নগরের মাদারবাড়ী এলাকায় গুলজার খালে প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের সময় দুটি ভবন, একটি মন্দির ও একটি কাঁচা ঘর হেলে পড়েছিল। আর গত ১৮ জানুয়ারি নগরের ষোলোশহর এলাকায় প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের জন্য খনন করা হলে চশমা খালে চারতলা ভবন হেলে পড়ে।
সিডিএ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের কাজ চলছে। এই প্রকল্পের আওতায় নগরের ৩৬টি খাল প্রশস্ত করা হচ্ছে। খালগুলোর পাশে নির্মিত হচ্ছে ৮৫ কিলোমিটার সড়ক। এসব কাজের জন্য জরিপের মাধ্যমে খালে ও খালের পাড়ে গড়ে ওঠা ভবনের তালিকা করা হয়েছে। শুধু রাস্তা ও ফুটপাত নির্মাণের জন্য খালের পাড়ে নির্মিত ১ হাজার ৮০৪টি স্থাপনা ভেঙে ফেলতে হবে। এর মধ্যে আধা পাকা ঘরবাড়িসহ একতলা থেকে শুরু করে বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবন অপসারণের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ২২৪ কোটি টাকা।
সিডিএ কর্মকর্তা বলছেন, এসব স্থাপনা ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গার ওপর; কিন্তু মালিকেরা খাল পাড়ের ড্যাপ নির্দেশিত নিয়ম মানেনি। অথচ সিডিএ থেকে নকশা অনুমোদনের সময় ১২ ফুট জায়গা খালিই দেখানো হয়। কিন্তু তদারকি না হওয়ায় তাঁরা জায়গা না ছেড়েই ভবন নির্মাণ করেছেন। এখন তাঁদের ক্ষতিপূরণ না দিলে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়াবে। তখন প্রকল্পই ঝুলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। তবে খালের জায়গা দখল করে গড়ে ওঠা ৩ হাজার ১১৫টি ভবন অপসারণ করা হলেও এ জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হয়নি।
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক ও সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. শাহ আলী প্রথম আলোকে বলেন, নগরের অধিকাংশ খালের পাশ দিয়ে চলাচলের কোনো সুযোগ ছিল না। তাই প্রতিরোধ দেয়ালের নির্মাণকাজ শুরুর পরিবর্তে ভবন অপসারণে মনোযোগ দিতে হয়েছে বেশি। যদি নিয়ম মেনে ভবনগুলো নির্মাণ করা হতো তাহলে জলাবদ্ধতা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ আরও দ্রুত গতিতে করা যেত। ব্যয়ও কম হতো।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা গেছে, নগরের কে বি আমান আলী সড়কের পাশে বাকলিয়া খালে নির্মাণকাজ চলছে। কিন্তু খালের পাড় ঘেঁষে নিজস্ব জায়গায় গড়ে ওঠা ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটি তিনতলা ভবনের একাংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। আরেক দোতলা ভবনের প্রায় অর্ধেক অংশ অপসারণ করা হয়েছে। আবার খালের ঠিক পাড় ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে ছয়তলা একটি ভবন। নিচতলা পাড় ঘেঁষে থাকলেও দোতলা থেকে ছয়তলার একাংশ খালের ওপর চলে এসেছে।
বাকলিয়া খালের পাশেই তিনতলা ভবনটি নির্মাণ করেন প্রবাসী শাহ আলম চৌধুরী। নির্মাণকাজের কারণে ভবনের একাংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, সিডিএর নকশা অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণ করেছিলেন। খালের জন্য পাঁচ ফুট জায়গাও ছেড়ে দিয়েছিলেন।
এ তো গেল বাকলিয়া খালের চিত্র। নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম চাক্তাই খালের দুই পাড়েও অনেক ভবন রয়ে গেছে। নগরের চকবাজারের প্যারেড মাঠের পূর্ব পাশে গিয়ে দেখা যায়, খালের দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে একতলা, দোতলা, চারতলাসহ অন্তত সাতটি ভবন।
সিডিএর উপপ্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ আবু ঈছা মো. আনছারী প্রথম আলোকে বলেন, খাল থেকে ১২ ফুট দূরত্ব রেখেই ভবনের নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু ভবনমালিকেরা তা মানেন না। জনবলের অভাবে সিডিএ অনেক সময় ঠিকভাবে তদারকি করতে পারে না। আর খালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।
সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, যখন কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়, তখনই এই ধরনের স্থাপনা ভেঙে দেওয়া হয়। কিন্তু এসব কাজ তদারকির জন্য যে পরিমাণ মানুষ থাকা দরকার তা সিটি করপোরেশনের নেই।
সিডিএ-সিটি করপোরেশনের গাফিলতিকে দায়ী করে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সিডিএ অবৈধ ও নকশা–বহির্ভূত ভবন নির্মাণকাজ বন্ধ করতে যেভাবে তদারকি করার কথা, তা করেনি। মনোযোগ দেয়নি সিটি করপোরেশনও। তাদের গাফিলতির কারণে ভবনমালিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে, যা জনগণের পকেট থেকেই যাবে।