পাঠকের লেখা–৬৭
মনের পর্দায় তাঁদের মুখ
প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]
২০০৭ সালের কথা। জগন্নাথ কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করে চাকরির পরীক্ষা দেওয়া শুরু করেছি মাত্র। মধ্যবিত্তের বেকার সন্তান, চাকরির পরীক্ষার ফি জোগাড় করাটাও কষ্টের হয়ে উঠেছে। তবু ছোট-বড় সব ধরনের চাকরিতে আবেদন করেই চলি। এরই মধ্যে জীবনের প্রথম বিসিএসের প্রিলিমিনারির ফল বেরোল। পাবলিক সার্ভিস কমিশন তখনো এতটা প্রযুক্তিনির্ভর হয়নি; বিজ্ঞপ্তি, ফলাফল—সবকিছুই তখন পত্রিকায় প্রকাশিত হতো।
বাসার পাশে পত্রিকা বিক্রির একটা ছোট্ট দোকান ছিল। দোকানি মামার সঙ্গে খাতির রাখতাম, যাতে ফ্রিতে কিছু পত্রিকা পড়তে পারি।
সেদিন গেলাম পত্রিকা দেখতে, দেখলাম উত্তীর্ণ হয়েছি। আনন্দিত হওয়ার কথা, কিন্তু আতঙ্কিত হলাম। লিখিত পরীক্ষার আছে মাত্র দুই মাস। প্রস্তুতি একেবারেই ছিল না। জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে তখন কয়েকটা টিউশনিই কেবল ভরসা। ভাবলাম দু-একটি টিউশনি রেখে বাকিগুলো ছেড়ে দেব। সময়টা ছিল গরমকাল। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বিকেলে একটি ভালো টিউশনি করতাম। লিখিত পরীক্ষা কাছাকাছি চলে আসায় রাত জেগে পড়াশোনা করি। দুপুরে খাওয়ার পর ক্লান্তিতে বুজে আসা চোখ নিয়ে মালিবাগ রেলগেট থেকে অনাবিল বা ছালছাবিল বাসে উঠতাম। জ্যামে ঠাসা রাস্তা ঠেলে টিউশনি শেষে ফিরতে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ ঘণ্টা চলে যেত। পরীক্ষা আরও কাছাকাছি এল। হিসাব করে দেখলাম, পরীক্ষায় ভালো করতে হলে ট্রাফিক জ্যামের তিন ঘণ্টা সময় কাজে লাগানোর বিকল্প নেই। ব্যাগে বই রাখা শুরু হলো। বাসে সিট পেলে বসে, না পেলে দাঁড়িয়েই পড়তে শুরু করি।
এমনই একদিনের ঘটনা। বাসে সিট না পেয়ে দাঁড়িয়েই সাধারণ জ্ঞানের বই পড়ছি। সিটে বসা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাকে অনেকক্ষণ দেখছিলেন। কিছুক্ষণ পর উনি আমার নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন এবং বাসে দাঁড়িয়েও কেন পড়ছি, তা-ও জানতে চাইলেন। বয়স্ক মানুষ, তাই তাঁর কাছে সেদিন মিথ্যা বলিনি। সবটা শুনে উনি আর কিছুতেই সিটে বসতে চাইলেন না। তিনি বয়স্ক হওয়ায় আমি বসতে আপত্তি জানালাম। আমাকে বসতেই হবে, সে কি পীড়াপীড়ি! বসতে একপ্রকার বাধ্যই হলাম। তিনি পরের স্টপেজে নেমে গেলেন। তবে নামার আগে আমার দিকে তাকিয়ে বড় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বলে মনে হলো। ‘ধন্যবাদ’ বলতে গিয়েও কেন যেন পারলাম না। এরপর কেটে গেছে অনেক দিন।
লিখিত পরীক্ষার রুটিন দেখে চক্ষু চড়কগাছ অবস্থা। বিসিএসে প্রতিটি বিষয়ের লিখিত পরীক্ষার আগে ন্যূনতম এক দিন বিরতি থাকার কথা। কিন্তু সেবারের সূচিতে পরীক্ষাগুলোর মাঝখানে কোনো বিরতি নেই। ফলে পরীক্ষা দিতে হলে আমার ঢাকায় টিকে থাকার একমাত্র অবলম্বন টিউশনি থেকে কমপক্ষে এক সপ্তাহের ছুটি ম্যানেজ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সন্তানদের লেখাপড়ায় এতটা বিরতি অভিভাবকেরা মানতে চান না। মন শঙ্কায় ছেয়ে গেল, টিউশনিটা এবার থাকবে না অথবা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারব না।
যা হওয়ার হবে ভেবে ছাত্রের মাকে সবকিছু বললাম। ভদ্রমহিলা চাকরিজীবী ছিলেন। সেদিনের আগে আমার সঙ্গে তেমন কথাবার্তা হয়নি। ধরেই নিয়েছিলাম আমাকে পরদিন থেকে আর না আসার জন্য বলবেন। কিন্তু অবাক করে তিনি আমাকে শুধু ছুটিই দিলেন না, উপরন্তু পরীক্ষার সময় আমার টাকার প্রয়োজন হতে পারে ভেবে সে মাসের বেতন আগেই দিয়ে দিলেন।
লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে, কিন্তু আমার পরীক্ষার তারিখ তখনো আসেনি। একদিন কী কাজে যেন পুরোনো বিমানবন্দরের সামনে দিয়ে যাচ্ছি। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সামনে দেখলাম অনেকেই ভাইভা দিয়ে বের হচ্ছেন। আবার বেশ কয়েকজনকে দেখলাম, যাঁরা বিভিন্ন কাজে ওখানে এসে ভাইভার খোঁজখবর নিচ্ছেন। আমিও দু-একজনের সঙ্গে কথা জুড়ে দিলাম। ভাইভা নিয়ে তাঁদের পড়াশোনা ও প্রস্তুতির ধারেকাছেও আমি নেই বলে মনে হলো। মনটা খারাপ হলো। ভাইভা উতরানোর আশা ক্ষীণ হয়ে এল। নির্দিষ্ট দিনে মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে ফলের অপেক্ষায় রইলাম।
মাস ছয় পরের কথা। টিউশনিতে বেরোব বলে প্রস্তুত হচ্ছিলাম। ফোনটা বেজে উঠল। এক নিকটাত্মীয় জানালেন, বিসিএসের ফল বেরিয়েছে। ধড়ফড় বুকে ছুটলাম সাইবার ক্যাফেতে। ডাউনলোড করা ফলাফলে আমার রেজিস্ট্রেশন নম্বরটা এল, কম্পিউটার স্ক্রিনটা তখন যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে আমার চোখে। মনের পর্দায় ভেসে উঠল বাসে বসার সিট করে দেওয়া সেই বয়স্ক মানুষটির মুখ আর টিউশনির ছাত্রটির মায়ের চেহারা। কৃতজ্ঞতায় দুফোঁটা অশ্রুর উষ্ণতা পেলাম দুই কপোলে।
মো. মেহেদী হাসান, জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, খুলনা