মাথাব্যথায়ও অ্যান্টিবায়োটিক দেন ওষুধের দোকানিরা

অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছা ব্যবহারের কারণে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জীবাণুর সংক্রমণছবি: সংগৃহীত

চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অথচ তিন পার্বত্য জেলায় দেদার বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল বিএমজে ওপেন–এ প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ ভাগ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন। মাথাব্যথার জন্যও অ্যান্টিবায়োটিক দেয় ওষুধের দোকানি। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।

গবেষণায় বলা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাথাব্যথা, সাধারণ জ্বর, কাশি, সর্দি—এসব রোগের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছে পাহাড়ি লোকজন। এজিথ্রোমাইসিন ও এমোক্সিসিলিন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। ফলে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এই জনগোষ্ঠীর ওপর অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতাও হারাবে।

গবেষণা দলে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আদনান মান্নান, নাইম উদ্দিন হাসান চৌধুরী, তানভীর এহসান ও গবেষক কল্যাণ চাকমা; রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক গৌরব দেওয়ান; চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষক মাসুদ রানা; চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক এইচ এম হামিদুল্লাহ; এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের অধ্যাপক নাজমুল আলম ও অয়ন সাহা; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমজাদ হোসেন ও ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের জান্নাতুন উনাইজা। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত পার্বত্য এলাকা ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পরে চলতি বছরের ৮ মার্চ প্রবন্ধটি বিএমজে ওপেন–এ প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষকেরা বলছেন, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ১ হাজার ৩৩৬ জন নারী ও পুরুষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, প্রতি দুজনের একজন অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেছেন। এমন যথেচ্ছ ব্যবহারের পেছনে চারটি কারণ বের হয়ে এসেছে। ১. দুর্গম এলাকার বাসিন্দাদের দূরত্বের কারণে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না যাওয়া, ২. চিকিৎসা খরচ নির্বাহে আর্থিক অসচ্ছলতা, ৩. নিকটস্থ ওষুধ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের কিংবা নিকট সম্পর্কের কারোর পরামর্শে কেনা এবং ৪. চিকিৎসকের পুরোনো ব্যবস্থাপত্র দেখে অ্যান্টিবায়োটিক কেনা।

গবেষক আদনান মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা হচ্ছে। তবে তিন পার্বত্য জেলার দুর্গম গ্রামের চিত্র আগে উঠে আসেনি। এ কারণেই গবেষণাটি করা হয়। এতে দেখা গেছে, সমতলের তুলনায় পার্বত্য অঞ্চলে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের হার বেশি। এমনকি মাথাব্যথার জন্য প্রায় ১৪ ভাগ পাহাড়ি অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন। অথচ মাথাব্যথার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের প্রয়োজন পড়ে না। ছাড়া ২১ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরাও দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এদের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই।

গবেষণায় বলা হয়, ২০ ভাগ পাহাড়ি ভুল অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ রোগের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক প্রাসঙ্গিক নয়। ৬০ ভাগ জানেন না অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে ক্ষতি কী হতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে অন্য ওষুধের পার্থক্য রয়েছে, সে বিষয়টি জানেন না ৭৫ ভাগ জনগোষ্ঠী।

এর আগে ২০১৯ সালের ৫ জুলাই চট্টগ্রামের একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স: বাস্তবতা, ভয়াবহতা ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক বৈজ্ঞানিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে মুখ্য আলোচক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সায়েদুর রহমান। এতে সায়েদুর রহমান অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের তথ্য তুলে ধরেন। বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতিদিন ১০ লাখ মানুষ অপচিকিৎসক কিংবা অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তির পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে থাকেন। আর বছরে সাড়ে ৩৬ কোটি মানুষ দুই থেকে তিনবার বিভিন্ন দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কেনেন। মাত্র পাঁচ কোটি মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করেন।

দরকার তদারকি

গবেষকেরা বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি ও তদারকি বেশি প্রয়োজন। পাহাড়িরা দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর নির্ভর করেছেন। অর্থাৎ বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করেছেন। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে নিজস্ব পদ্ধতি কাজ না–ও করতে পারে। এ ছাড়া এই অঞ্চলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ঘাটতি রয়েছে।

সাজেক ইউনিয়নের কিচিংপাড়ার কারবারি (পাড়াপ্রধান) বিজয় তালুকদারের সঙ্গে তাঁদের নিজস্ব চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে কথা হয়। পঁয়তাল্লিশোর্ধ্ব বিজয় প্রথম আলোকে বলেন, জ্বর, মাথাব্যথা কিংবা ছোটখাটো রোগে তাঁরা নিজেরাই ভেষজ ওষুধ ব্যবহার করে আসছেন। গ্রামে বয়স্ক ব্যক্তিরা বনের লতাপাতা দিয়ে দীর্ঘকাল ধরে এসব ওষুধ তৈরি করেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তরুণেরা মুঠোফোনে খুঁজে অথবা কারও কাছ থেকে শুনে ওষুধের দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খাচ্ছেন। ছোটখাটো অসুখেও অ্যান্টিবায়োটিক কিনছেন।

রাঙামাটি সদরে অবস্থিত বড় মহাপুরম উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক পদ্ম রঞ্জন চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামাঞ্চলে এখনো ভেষজ চিকিৎসাপদ্ধতি চালু আছে। কিন্তু শহর অঞ্চলে এসব দেখা যায় না বললেই চলে। এ ছাড়া প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে। অনেকে দোকান থেকে ওষুধ কিনে রোগের চিকিৎসা করছেন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন না। এ কারণে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে সচেতন করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

গবেষণা দলের সদস্য চট্টগ্রাম ও রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক মাসুদ রানা ও গৌরব দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ওষুধ ও প্রসাধনী আইন ২০২৩ অনুযায়ী, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধে ২০ হাজার টাকা জরিমানা ও ৬ মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। কিন্তু আইন প্রয়োগ তেমন করা হয় না বললেই চলে। গবেষক দলের পরামর্শ হলো, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনোভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করতে দেওয়া যাবে না। তিন পার্বত্য জেলায় চিকিৎসক ঘাটতি পূরণ করতে হবে।