তিক্ত সত্য, বড় বার্তা

আলতাফ পারভেজফাইল ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলোর এই জরিপ বর্তমান সময় এবং আসন্ন আগামীকে বুঝতে বাস্তবসম্মতভাবে বেশ সাহায্য করে। এটা প্রয়োজনীয় কাজ হয়েছে। বাইরের দেশগুলোয় বিভিন্ন সংস্থা আর্থসামাজিক বিষয়ে মাঝেমধ্যে এ রকম জরিপ করা হয়।

করাচির দৈনিক ডন-এ প্রতিবছর এ রকম দু-তিনটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ হতে দেখেছি, যা পাকিস্তানের সমাজের গতিশীলতা বুঝতে সহায়তা করে। দক্ষিণ এশিয়ার মিডিয়াজগতে ডন-এর আকর্ষণের বড় দিক তাদের এ রকম কাজ।

অতীতে প্রথম আলোও এ ধরনের জরিপ প্রকাশ করেছে। তবে দীর্ঘ কয়েক বছর তাদের কোনো রাজনৈতিক জরিপ প্রকাশ করতে দেখিনি।

বাংলাদেশে কোনো সংবাদপত্রের পক্ষে চূড়ান্ত পেশাদারত্বের সঙ্গে এ রকম জরিপ করা আর্থিক কারণে দুরূহ। এখানে প্রিন্ট মিডিয়ার বাজার খুব ছোট। তাদের নেতৃত্বের ইচ্ছা ও সাহসের পরিসরও নানা সামাজিক কারণে আঁটসাঁট। এ রকম পটভূমিতে এ জরিপ ব্যতিক্রমী। তবে এর নমুনাসংখ্যা অল্প। যদিও পরিসংখ্যানশাস্ত্রের সূত্রমতে শহর-গ্রাম, নারী-পুরুষ, বয়স-পেশা ইত্যাদি মিলিয়ে করা হলে ছোট নমুনা দিয়েও সমাজের গতিশীলতার ধরন সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত শনাক্ত করা সম্ভব। এখানে সেটা পাওয়া যাচ্ছে বটে।

উত্তরদাতাদের মতামত থেকে চার-পাঁচটা বিষয়ে কিছু মন্তব্য করা যায়। যেমন জরিপে গত ১৫ মাসের সরকারি কাজের একটা মূল্যায়ন করেছেন ১ হাজার ৩৪২ জন। ৭৫ শতাংশ বলেছেন, কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেনি সরকার। তরুণ-তরুণীদের গণ-অভ্যুত্থানের পাটাতন তৈরি হয়েছিল কর্মসংস্থানের বিষয়কে ঘিরে। সে ক্ষেত্রে সরকারের প্রতি জন-অসন্তুষ্টি বেশ স্পষ্ট। অজ্ঞাত কারণে রাজনীতির মাঠ থেকে চাকরি ও কাজের আলাপটা লাপাত্তাও হয়ে গেল, যা বেশ রহস্যময়।

প্রথম আলো গ্রাফিকস

জরিপে ৬৩ শতাংশ উত্তরদাতা ধর্মীয় সহিষ্ণুতা রক্ষায় সরকারকে কৃতিত্ব দিয়েছেন। বিপুল মাজার ভাঙাভাঙি এবং কবর থেকে লাশ তুলে পুড়িয়ে ফেলার মতো ঘটনার বিপরীতে এই উপাত্ত বেশ বিস্ময়কর লাগতে পারে অনেকের কাছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রান্তিক বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘুদের সহায়-সম্পদে হরেদরে হামলা হতে দেখেছি আমরা। তার সঙ্গে এই মতামত মিলিয়ে পাঠ করতে গিয়ে নিশ্চিতভাবে এক নিদারুণ সত্যের মুখোমুখি হতে হয়।

আলোচ্য জরিপের নমুনা সংখ্যার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের প্রাধান্য থাকা স্বাভাবিক। এ রকম হতে পারে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা মাজার-খানকার লাঞ্ছনা ওই সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে মোটাদাগে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় আর। গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সমাজে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ-জুলুমপন্থা বেড়ে গিয়ে থাকে, সেটাকে নির্মোহভাবে পাঠ না করে জরিপশাস্ত্রের কোনো উপায় থাকে না। পরিসংখ্যানবিদ্যা নৈতিক করণীয়র কথা বলে না; বাস্তবতাকে সামনে আনে মাত্র। সামাজিক সব সত্যকে পাঠ করার নৈতিক বল আসন্ন বাংলাদেশের থাকতে হবে বৈকি। বাংলাদেশের সমাজে যদি প্রকৃতই হিংসার রাজনীতি ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে, তাকে আগেভাগে বুঝতে দিয়ে এ রকম জরিপ সাহায্যই করছে বলতে হয়।

জরিপে প্রায় ৬৬ শতাংশ মানুষ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় সরকারের যে ইতিবাচক ভূমিকা দেখেছেন, সেটাও বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে। যদিও গত বছর ক্ষমতাচ্যুত দলের কর্মী-সমর্থকেরা এ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতি নেওয়া পদক্ষেপগুলোর কথা তুলতে পারেন। ওই সরকার দুর্নীতির যে সর্বগ্রাসী সংস্কৃতি রেখে গিয়েছিল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেটা থেকে জনসমাজকে মুক্ত করতে পারেনি বলেও জরিপের ৭৫ শতাংশ উত্তরদাতা জানাচ্ছেন। এটা নিশ্চিতভাবে গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশার বিপরীতে দুর্ভাবনার বড় এক জায়গা।

মানুষের দুর্ভাবনা আছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও। প্রায় ৮১ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘ভালো’ ভূমিকা রাখবে বলে তারা আশা করছে। এটা হয়তো বাংলাদেশের সমাজের শৃঙ্খলাকাঠামোর ক্রমে সশস্ত্র বাহিনী নির্ভরতার ইঙ্গিত দেয় বা একই সঙ্গে ভরসার জায়গাও নির্দেশ করে। তবে সমাজের ভেতরকার ক্রমবর্ধমান ভঙ্গুর দশার অন্য ধরনের কিছু উপাত্ত মিলে জরিপের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অংশ। সেখানে মনোযোগ পাওয়ার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, গত ১৫ মাসে প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষের পকেটে টাকাকড়ি আসা কমে গেছে। এ ক্ষেত্রে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সব উত্তরদাতার একই অভিজ্ঞতা।

আয়রোজগার-সংকটের তিনটা দিক থাকে: কর্মসংস্থান কমা, জিনিসপত্রের দাম বাড়া ও মজুরি কমা। তিনটা একসঙ্গে ঘটলে দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ে। বিশ্বব্যাংকসহ নির্ভরযোগ্য সবাই ইদানীং বলছে, বাংলাদেশ দারিদ্র্য কমানোর উল্টো রাস্তায় হাঁটছে। জরিপেও দেখা গেল, গত ১৬ মাসে আয় বেড়েছে এমন কথা জানাচ্ছেন প্রায় ১২ শতাংশ মানুষ। আয় কমেছে বলছেন ৪২ শতাংশ। পাশাপাশি পরিবারের মাসিক খরচ বেড়ে গেছে বলছেন গড়ে প্রায় ৭৯ শতাংশ মানুষ। এই দুই প্রবণতার যোগফল কিন্তু বিপজ্জনক কিছু নির্দেশ করে।

প্রথম আলো গ্রাফিকস

প্রশ্ন হলো, এই যদি বাস্তবতা হয়, তাহলে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে প্রমোশন পাবে বা প্রমোশন নেবে কীভাবে?

এলডিসি থেকে উত্তরণের বড় শর্ত আয়ের অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সামাল দেওয়ায় অগ্রগতি। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে এটা স্পষ্টভাবে ঘটছিল। বিগত তিন-চার বছর এবং বর্তমান জরিপের আলোকে গত ১৫ মাসের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখছি, কর্মসংস্থানও বাড়ছে না, সমাজের বড় একাংশের আয়ও কমছে। এ রকম পটভূমিতে বাংলাদেশ যদি উন্নয়নশীল দেশের ইমেজ গ্রহণে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং তাতে যদি রপ্তানি খাতে এলডিসির জন্য প্রাপ্ত সুবিধা কমে যায়, সেটা কর্মসংস্থান পরিস্থিতিকে বাড়তি জটিল করবে। উন্নয়নশীল দেশে এনজিও সহায়তাও কমে।

এসব বিবেচনায় প্রথম আলোর এই ছোট জরিপ বর্তমান ও আগামীর বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য দরকারি অনেক পরামর্শ হাজির করছে।

জরিপটি করা হয় গত অক্টোবরে। জরিপের এক জায়গায় দেখলাম, আয়রোজগারে গত ১৫ মাসে অসন্তুষ্টি এবং নেতিবাচক মনোভাব সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম, সিলেটসহ মেট্রোপলিটন (নগর) সমাজে। ঠিক এ সময় রাজনীতি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখছি, বাংলাদেশের সমাজকে, বিশেষ করে শহুরে তরুণসমাজকে খুব সচেতনভাবে কারা যেন ধর্মীয় এবং নৈতিক-সাংস্কৃতিক কাজিয়ায় লাগিয়ে রাখছে। পলিটিক্যাল-ইকোনমির প্রবণতা থেকে সমাজের নজর সরিয়ে রাখতেই হয়তো কেউ এসব করাচ্ছেন। কিন্তু তাতে কি সামাজিক সংকট আদৌ ধামাচাপা থাকে? ‘লাল জুলাই’য়ের অভিজ্ঞতা কী বলে?

  • আলতাফ পারভেজ গবেষক