নিজেদের মতের সঙ্গে না গেলে মবতন্ত্রের (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণ) মাধ্যমে বই পোড়ানো ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে হামলার সংস্কৃতি ফেরানো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান।
গতকাল শনিবার রাজধানীর ডেইলি স্টার সেন্টারে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে রেহমান সোবহান এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। চলতি বছরের ১০ ডিসেম্বর ৫০ বছর পূর্ণ করেছে দেশের অন্যতম এ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি।
রেহমান সোবহান বলেন, ‘এটি একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক সংস্কৃতি, যা আদতে আপনাকে নাৎসি জার্মানি এবং সেই সময়ে তাদের চালু করা বই পোড়ানোর সংস্কৃতির দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। আমি আশা করছি, আমরা সম্ভবত তুলনামূলক একটি ভালো গণতান্ত্রিক সময়ের নতুন এই যুগে এ ধরনের সংস্কৃতির মুখোমুখি হব না।’
এ সময় এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ইংরেজি প্রকাশনাগুলো রক্ষা পাওয়ার একটি কারণ হলো শাসকশ্রেণি ব্যাপকভাবে বই পড়ে না। তবে দিন শেষে মানুষ বই পড়ে। আর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কেউ কেউও পড়ে এবং সরকারকে নিয়ে লেখা যেসব বিষয় ‘তাদের পক্ষে যায় না’, সেগুলো চিহ্নিত করে রাখে।
এ সময় ইউপিএল নিয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে রেহমান সোবহান বলেন, ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) থাকার সময়ে মহিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বই ছাপানোর পার্টনারশিপ চালু করি। তখন ইউপিএল আমাদের গবেষণাকাজ প্রকাশের দায়িত্ব নেয়। মহিউদ্দিন আহমেদ গুণগত মানের দিকে লক্ষ রেখে আমাদের বই কেবল ছাপাননি, এটি মানুষের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্বও নেন। সে সময় এটি ছিল প্রথম একটি সফল পার্টনারশিপ।’
সিপিডির চেয়ারম্যান বলেন, ‘এরপর বিআইডিএস ছাড়ার পর সিপিডির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বই ছাপানোর কাজ শুরু হয়। ইউপিএল কেবল বই ছাপায়নি, লেখকদের জন্য একটি সুসম্পাদিত বই প্রকাশের নির্ভরযোগ্য স্থান হিসেবে তৈরি হয়। মহিউদ্দিন আহমেদের প্রয়াণের পর তাঁর কন্যা মাহ্রুখ মহিউদ্দিন প্রকাশনা সংস্থাটির নেতৃত্ব দেন। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’
অনুষ্ঠানে আলোচকেরা বলেন, ইউপিএল তার জন্মলগ্ন থেকে বই প্রকাশের বিষয়ে মান বজায় রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেছে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের যে আহ্বানে ইউপিএল গ্রন্থ প্রকাশ করে, তা দেশের মানুষের জ্ঞান আহরণ ও চর্চার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য স্থান।
পাঠক-লেখক-শুভানুধ্যায়ীদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানটি মিলনমেলায় পরিণত হয়। সুবর্ণজয়ন্তীতে লেখক, অনুবাদক, সম্পাদক ও শুভানুধ্যায়ীরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা ইউপিএলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সময় নিয়ে তাঁদের স্মৃতিচারণা করেন।
আলোচকেরা আরও বলেন, ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৫০ বছর ধরে গবেষণামূলক প্রকাশনা, বিশেষ করে বিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, উন্নয়ন-অধ্যয়নে গ্রন্থ প্রকাশ ও পাঠে ইউপিএল অবদান রাখছে।
অনুষ্ঠানে অতিথিদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, রাশেদা কে চৌধূরী, আলী রীয়াজ, নিয়াজ জামান, মেহতাব খানম, রামেন্দু মজুমদার, আইরিন খান, রেহনুমা আহমেদ, পারভীন হাসান, সারা হোসেন, ফারুক মঈনুদ্দীন, সাজ্জাদ শরিফ, সামিনা লুৎফা, সাঈদ ফেরদৌস, আশা মেহরিন আমিন, কাজুইয়ো মিনামিদে, মোশাহিদা সুলতানা, সব্যসাচী হাজরা, মোশাহিদা সুলতানাসহ অনেক শিক্ষক, কবি, লেখক ও শুভানুধ্যায়ী। অতিথিদের স্বাগত জানান ও তাঁদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন ইউপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহ্রুখ মহিউদ্দিন।
সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে ইউপিএলের প্রতিষ্ঠাতা ইমেরিটাস প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ এর স্মরণে ‘আরশি ট্রাস্ট’-এর উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। আরশি ট্রাস্ট বই ও জ্ঞান সৃষ্টি, চর্চা ও সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা।